কলকাতার কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রীকে গণধর্ষণ, গ্রেফতার তিন

কলকাতার একটি কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রীকে গণধর্ষণের অভিযোগে উত্তাল হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাঙ্গন ও রাজনৈতিক অঙ্গন। ঘটনাটি ঘটে দক্ষিণ কলকাতার একটি নামী আইন কলেজে, যেখানে ২৫ জুন কলেজেরই এক ছাত্রীকে ক্যাম্পাসের মধ্যেই গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ দ্রুত অভিযানে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে, যাদের সবাই কলেজটির ছাত্র এবং তাদের মধ্যে কমপক্ষে একজনের সঙ্গে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের ছাত্র শাখার সরাসরি যোগসূত্র ছিল বলে স্বীকার করেছে সংশ্লিষ্ট সংগঠনের নেতৃত্ব।
ঘটনার বিবরণ
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২৫ জুন সন্ধ্যায় দক্ষিণ কলকাতার ল ল কলেজ ক্যাম্পাসেই এ ঘটনা ঘটে। অভিযোগ অনুযায়ী, কলেজ ছুটির পরে একটি নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে ওই ছাত্রীকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে তিনজন ছাত্র। ঘটনার ভয়াবহতায় স্তম্ভিত ছাত্রীটি প্রথমে চুপ থাকলেও পরদিন, ২৬ জুন, স্থানীয় কসবা থানায় গিয়ে ঘটনার বিস্তারিত অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযোগ পেয়ে পুলিশ দ্রুত মেডিকেল পরীক্ষার ব্যবস্থা করে এবং প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে ঐ দিন সন্ধ্যাতেই দুজন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে। বাকি একজনকে গভীর রাতে হেফাজতে নেওয়া হয়। পরদিন, ২৭ জুন (শুক্রবার) তিনজনকেই আলিপুর আদালতে তোলা হলে চারদিনের পুলিশ হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক।
গ্রেফতারকৃতদের পরিচয় ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা
গ্রেফতার হওয়া তিনজনের মধ্যে দুজন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র এবং একজন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। জানা গেছে, তাদের মধ্যে একজন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) সক্রিয় কর্মী, যিনি দীর্ঘদিন ধরে কলেজ ক্যাম্পাসে সংগঠনের পক্ষ থেকে কাজ করছিলেন। বিষয়টি নিয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের পক্ষ থেকে প্রথমে কোন মন্তব্য না করা হলেও পরবর্তীতে সংগঠনের এক শীর্ষ নেতা গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন যে অভিযুক্তদের মধ্যে একজনের সঙ্গে সংগঠনের “অফিশিয়াল” সম্পৃক্ততা ছিল।
তবে সংগঠনটি এক বিবৃতিতে জানায়, “টিএমসিপি কোনো অপরাধীকে আশ্রয় দেয় না। আমরা আইনগত প্রক্রিয়াকে সম্মান করি এবং অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।”
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা
ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন আইনের অধীনে তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ধারায় দোষী সাব্যস্ত হলে ২০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে। বর্তমানে কলকাতা পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (SIT) এই মামলার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে এবং ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ, ছাত্রছাত্রীদের বক্তব্য এবং অভিযুক্তদের মোবাইল ফোন জব্দ করে ফরেনসিক বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
ভুক্তভোগী ছাত্রী ও তার পরিবারের অবস্থান
ভুক্তভোগী ছাত্রীর পরিবার বর্তমানে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ছাত্রীটির একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জানান, “আমরা কোনো রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি চাই না। আমরা চাই আমার মেয়ের সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে, তার বিচার হোক দ্রুততম সময়ে। ও এখন মানসিক ট্রমার মধ্যে আছে।”
ছাত্রীটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কসবা থানার পক্ষ থেকে তার বাসস্থানে নিয়মিত পুলিশ পেট্রোলিং রাখা হচ্ছে এবং একটি মহিলা পুলিশের দলও তাকে সার্বক্ষণিক সহায়তা দিচ্ছে।
শিক্ষাঙ্গনে উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর শিক্ষামহলে চরম ক্ষোভ ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, “কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। এই ধরনের অপরাধ ঠেকাতে কলেজ কর্তৃপক্ষকে আরও কড়া নজরদারি চালাতে হবে। আমরা বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।”
অন্যদিকে, কলেজটির অধ্যক্ষ একটি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, “আমরা সম্পূর্ণভাবে তদন্তকারী সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করছি। অভিযুক্তদের ছাত্রত্ব সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। শিক্ষাঙ্গনকে নিরাপদ রাখার জন্য আমরা ভবিষ্যতে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেব।”
সমাজ ও রাজনীতিতে প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনা শুধু শিক্ষাঙ্গনে নয়, রাজ্যজুড়ে রাজনৈতিক আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। বিজেপি, সিপিএমসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এই ঘটনায় শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের নাম জড়িয়ে পড়ায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ সভাপতি বলেন, “রাজ্যের শিক্ষাঙ্গন আজ তৃণমূলের পৃষ্ঠপোষকতায় অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এই ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে এমন ঘটনা বারবার ঘটবে।”
অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, “এই ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয়। তৃণমূল কংগ্রেস কোনও অপরাধীকে রক্ষা করে না। দলের অবস্থান পরিষ্কার—আইন আইনের পথে চলবে।”
নারী অধিকার সংগঠন ও মানবাধিকার কর্মীদের প্রতিক্রিয়া
নারী অধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে। ‘সেইফ ক্যাম্পাস নাউ’ নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, “কলেজ ক্যাম্পাসে এমন ঘটনা প্রমাণ করে প্রশাসনের ব্যর্থতা ও কলেজ কর্তৃপক্ষের গাফিলতি। কলেজগুলিতে জরুরি ভিত্তিতে নারী নিরাপত্তা সেল গঠন ও মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে।”
মানবাধিকার কর্মী কবিতা কৃষ্ণন বলেন, “এটা শুধু ধর্ষণ নয়, এটি শিক্ষাঙ্গনে নারীদের নিরাপত্তার প্রতি চূড়ান্ত হুমকি। সরকার ও কলেজ কর্তৃপক্ষকে দায় নিতে হবে।”
উপসংহার
এই ঘটনা একটি গভীর সামাজিক সংকটকে সামনে এনে দিয়েছে—নারী নিরাপত্তা, শিক্ষাঙ্গনের স্বচ্ছতা, এবং ছাত্র রাজনীতির অন্ধকার দিক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্রুত পদক্ষেপ প্রশংসনীয় হলেও সমাজ ও রাজনীতিকে এখন আত্মসমালোচনার প্রয়োজন। শিক্ষাঙ্গনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে শুধু আইন নয়, প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
প্রতীক্ষা এখন ন্যায়বিচারের। ভুক্তভোগী ও তার পরিবার যেন যথাযথ বিচার পায়, সেই আশা নিয়ে গোটা রাজ্য নজর রাখছে এই মামলার পরবর্তী অগ্রগতির দিকে।