প্রতিবেশীদের দিকে ‘নিবিড় নজর’ রাখি, বাংলাদেশ-চীন-পাকিস্তানের বৈঠক নিয়ে জয়সওয়াল

সম্প্রতি বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠককে ঘিরে ভারতের কূটনৈতিক মহলে সরব প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা প্রতিবেশীদের সকল কার্যক্রমে ‘নিবিড় নজর’ রাখছে এবং এসব সম্পর্ক ও যোগাযোগকে মূল্যায়নের সময় বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এই বার্তা দিয়েছেন এক নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে।
ভারতের এমন কূটনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, তারা দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্ভাব্য ঘনিষ্ঠতাকে সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের নেতৃত্বে গত ১৯ জুন চীনের কুনমিং শহরে যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে পাকিস্তান ও চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠককে কেন্দ্র করে ভারতের উদ্বেগ প্রকাশ স্বাভাবিক এবং কূটনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিশ্লেষকদের মত।
ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের প্রতিক্রিয়ায় নয়াদিল্লি
বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সাপ্তাহিক প্রেস ব্রিফিংয়ে রণধীর জয়সওয়ালকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক নিয়ে ভারতের অবস্থান কী। এর উত্তরে তিনি বলেন, “দেখুন, আশপাশের অঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহে আমরা সবসময় নিবিড় নজর রাখি। কারণ এগুলো আমাদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত।”
তিনি আরও বলেন, “প্রতিটি দেশের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক, তা আলাদা আলাদা ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই সম্পর্ক বিচার করার সময় আমরা পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটও বিবেচনায় নিয়ে থাকি।” এই বক্তব্যে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে, ভারত কেবল দ্বিপক্ষীয় নয়, বহুপাক্ষিক সম্পর্কও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যায়ন করছে।
বাংলাদেশের অবস্থান ও বৈঠকের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই বৈঠককে ‘সুশীল কূটনীতির অংশ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও, এতে পাকিস্তান ও চীনের উপস্থিতি কূটনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়। এই তিন দেশের মধ্যে কোন ধরনের রাজনৈতিক বা নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না, তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না হলেও, ভারত বিষয়টিকে যে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে, তা জয়সওয়ালের বক্তব্যেই পরিস্কার।
এদিকে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন একই দিন ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক ব্রিফিংয়ে বৈঠকটি নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা দেন। তবে কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের উদ্বেগ দূর হয়েছে বলে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
নদীর পানি বণ্টন চুক্তি: মেয়াদ শেষের মুখে
একই ব্রিফিংয়ে ভারতের আরেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির ভবিষ্যত নিয়েও আলোচনা ওঠে। এবিপি নিউজের সাংবাদিক অগ্নি রায় জানতে চান, ২০২৬ সালে মেয়াদ শেষ হতে যাওয়া এই চুক্তি নবায়নের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়েছে কিনা।
জবাবে রণধীর জয়সওয়াল বলেন, “ভারত ও বাংলাদেশ—আমরা গঙ্গাসহ একে অপরের সঙ্গে ৫৪টি নদীর পানি ভাগাভাগি করি। আর এসব নিয়ে আলোচনার জন্য দুই দেশের যৌথ নদী কমিশন রয়েছে।” অর্থাৎ, আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনার পথ খোলা থাকলেও, চুক্তি নবায়নের বিষয়ে কোনো দৃঢ় অঙ্গীকার বা অগ্রগতি এখনো জানানো হয়নি।
বাণিজ্য বিষয়ে ভারতীয় অবস্থান
ব্রিফিংয়ে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। সাংবাদিক গৌতম লাহিরি জানতে চান, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো বাণিজ্যিক ইস্যুতে যোগাযোগ করা হয়েছে কিনা।
জয়সওয়াল বলেন, “ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে যেসব বিষয়ে পরিবর্তন আনতে বলা হয়েছে, সেগুলো ন্যায়বিচার, সমমর্যাদা এবং পারস্পরিক চাওয়ার ভিত্তিতেই নির্ধারিত।” তিনি আরও বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা এসব বিষয়ের সমাধানের অপেক্ষায় আছি।”
এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, ভারত কিছু নির্দিষ্ট বাণিজ্যিক জটিলতা ও নীতি সংক্রান্ত বিষয়ের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ইতিবাচক পদক্ষেপের প্রত্যাশা করছে।
খিলক্ষেতে মন্দির ভাঙা নিয়ে উদ্বেগ
ব্রিফিংয়ে ঢাকার খিলক্ষেতে একটি হিন্দু মন্দির ভাঙা নিয়ে ভারতের অবস্থানও উঠে আসে। গৌতম লাহিরি এ বিষয়ে জানতে চাইলে জয়সওয়াল বলেন, “আমরা জানতে পেরেছি, কট্টরপন্থিরা সেখানে একটি মন্দির ভাঙার দাবি তুলেছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকার মন্দিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে উল্টো অবৈধ জমি ব্যবহারের যুক্তিতে সেটি ভাঙার অনুমতি দিয়েছে।”
তিনি বলেন, “আমরা অত্যন্ত হতাশ যে বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে। আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ, তাদের সম্পদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষা করার দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের।” এই বক্তব্য ভারত সরকারের ঐতিহ্যগত হিন্দু সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ইস্যুতে অবস্থান প্রতিফলিত করে।
কূটনৈতিক ইঙ্গিত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কের দিকনির্দেশ
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের এই অবস্থান মূলত দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা ও সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সম্ভাব্য প্রভাবের পূর্বাভাস হিসেবেই বিবেচিত হতে পারে। বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতা এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে চীনের যোগাযোগে ভারতের সতর্ক প্রতিক্রিয়া নতুন নয়।
তবে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যালান্সিং অ্যাক্ট বা সমান্তরাল কূটনীতির প্রয়াস এখন স্পষ্টতই দিল্লির নজরে রয়েছে। ভবিষ্যতে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের মতো উদ্যোগ আরও বাড়লে, ভারত হয়তো আরো কঠোর কূটনৈতিক বার্তা দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বহুস্তরীয় এবং ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠ হলেও, চীনের সক্রিয় উপস্থিতি এই সম্পর্কের জটিলতা বাড়িয়ে তুলছে। তাই বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—এই অঞ্চলীয় কূটনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা করা।