আঞ্চলিক

নড়াইলে বজ্রপাতে বাবার সামনে ছেলের মৃত্যু

নড়াইল সদরে এক হৃদয়বিদারক ঘটনার জন্ম দিয়েছে হঠাৎ বজ্রপাত। বাবার চোখের সামনে বজ্রাঘাতে প্রাণ হারিয়েছে এক মাদ্রাসাছাত্র। বৃহস্পতিবার সকালে নড়াইল সদর উপজেলার শাহাবাদ ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত ছাত্রের নাম জোবায়ের বিশ্বাস ওরফে মিঠুল (২০)। সে জুড়ালিয়া আলিম মাদ্রাসার প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় কৃষক আমিনুর বিশ্বাসের ছেলে।

স্থানীয় সময় সকাল পৌনে ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে বলে নিশ্চিত করেছেন নড়াইল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাজেদুল ইসলাম। ঘটনার সময় জোবায়ের তার বাবার সঙ্গে মাঠে কৃষিকাজে ব্যস্ত ছিলেন। হঠাৎ শুরু হওয়া ভারি বর্ষণ ও বজ্রপাতের মধ্যে একটি বজ্রপাত সরাসরি জোবায়েরের ওপর আঘাত হানে। ঘটনাস্থলেই তিনি গুরুতর আহত হন এবং পরবর্তীতে হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

মর্মান্তিক দৃশ্য: বাবার সামনেই সন্তানের শেষ নিঃশ্বাস

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কৃষিকাজে সহায়তার উদ্দেশ্যে মিঠুল সকালে বাবার সঙ্গে জমিতে যান। মাঠে আগাছা পরিষ্কার করতে করতেই বৃষ্টি শুরু হয়। আশেপাশে বজ্রপাত শুরু হলে তাঁরা দ্রুত কাজ গুটিয়ে ফিরতে চাইলেও মুহূর্তেই বজ্রপাত এসে পড়ে মিঠুলের ওপর। তীব্র শব্দে আশপাশ কেঁপে ওঠে। মিঠুল পড়ে যান মাটিতে, আর তার শরীরের বিভিন্ন অংশ ঝলসে যায়। বাবাও পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, ফলে তিনিও আঘাত পান। তবে প্রাথমিক চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হন।

এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে জমির আশপাশে থাকা স্থানীয় কৃষকরাও স্তব্ধ হয়ে যান। তারা দ্রুত এগিয়ে এসে বাবা-ছেলেকে উদ্ধার করে নড়াইল সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু চিকিৎসকরা মিঠুলকে মৃত ঘোষণা করেন।

চিকিৎসকেরা জানান, বজ্রপাতের কারণে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।

একই সময়ে আরও দুই নারী আহত

এদিন শুধু মিঠুলই নয়, বজ্রপাতের শিকার হয়েছেন আরও দুই নারী। শাহাবাদ ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামেরই সমির মোল্যার স্ত্রী লাভলী বেগম (৩৮) এবং নড়াইল সদরের দুর্গাপুর এলাকার লিলি বেগম (৬০) পৃথক বজ্রপাতে আহত হয়েছেন। তাদেরকেও নড়াইল সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে তাদের অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

স্থানীয়রা জানান, সকালে হঠাৎ করে আকাশে কালো মেঘ জমে এবং তার কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় প্রচণ্ড ঝড় ও বজ্রসহ বৃষ্টি। অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও, ক্ষেত-খামারে থাকা মানুষজনের জন্য তা সম্ভব হয়নি। এর ফলে এই দুর্ঘটনা ঘটে।

থানায় অপমৃত্যুর মামলা, লাশ হস্তান্তর

নড়াইল সদর থানার ওসি মো. সাজেদুল ইসলাম জানান, বজ্রপাতে একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু এবং দুই নারীর আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা রুজু করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়া শেষে নিহতের মরদেহ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, বর্ষাকালে এ ধরনের বজ্রপাতের ঘটনা সাধারণত বেশি ঘটে। মানুষকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। বিশেষ করে বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠ, জলাশয় বা উঁচু স্থানে অবস্থান না করার পরামর্শ দেন তিনি।

মিঠুলের মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া

এ ঘটনায় চাঁদপুর গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। মিঠুলের সহপাঠী, মাদ্রাসার শিক্ষক, প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন সবাই শোকাহত। গ্রামের মসজিদে বিশেষ দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে তার আত্মার মাগফিরাত কামনায়।

জুড়ালিয়া আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ জানান, “মিঠুল ছিল অত্যন্ত ভদ্র, মনোযোগী এবং ধর্মপরায়ণ ছাত্র। তার এমন অকাল মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।”

নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে জানা গেছে, মিঠুল ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে। ভবিষ্যতে হাফেজ হয়ে একজন সম্মানজনক আলেম হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু এক মুহূর্তের বজ্রাঘাতে সেই স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে গেল।

সতর্কতা ও করণীয়

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। বিশেষ করে ভোর ও সন্ধ্যার দিকে ঝড়বৃষ্টি হলে বজ্রপাতের ঝুঁকি বাড়ে। এসময় মাঠ-ঘাটে কাজ না করা, উঁচু গাছ বা বিদ্যুৎবাহী তার থেকে দূরে থাকা, খালি পায়ে না থাকা ও দ্রুত ঘরের মধ্যে আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে বজ্রপাত প্রতিরোধে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় ‘বজ্রনিরোধক দণ্ড’ স্থাপন, জনসচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন এবং বজ্রপাতের সময় করণীয় বিষয়ক প্রশিক্ষণ।

উপসংহার

নড়াইলের এই দুর্ঘটনা আবারও প্রমাণ করলো, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কতটা ভয়াবহ এবং অকস্মাৎ হতে পারে। বজ্রপাতের মতো দুর্যোগে প্রাণহানির ঘটনা প্রতিরোধে জনসচেতনতা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও সময়োপযোগী সতর্কতা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। একটি তরুণ প্রাণের এমন অপমৃত্যু শুধু একটি পরিবারকেই নয়, সমগ্র সমাজকে নাড়া দেয়। এই ঘটনায় শোক জানিয়ে প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button