আঞ্চলিক

৮ আগস্টকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ ঘোষণা করল সরকার

সরকার ৮ আগস্টকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ এবং ১৬ জুলাইকে ‘শহীদ আবু সাঈদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই দুটি দিবস প্রতি বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বুধবার (২৫ জুন) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে দুটি আলাদা পরিপত্র জারি করে এই ঘোষণা দেওয়া হয়।

ইতিহাসের মোড়ে একটি নতুন অধ্যায়

গত বছরের ৮ আগস্ট, দেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও প্রশাসনিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করেন। তার নেতৃত্বাধীন সরকারকে দায়ী করে বহুদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিলো বিভিন্ন ছাত্র ও নাগরিক সংগঠন। সেই আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ নেয় জুলাই মাসে শুরু হওয়া গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে।

গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতৃত্বে আসেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক ধারা শুরু হয়—যা নতুন বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্নকে বাস্তবের পথে এগিয়ে নেয়।

সরকার এই দিনটিকে শুধুমাত্র স্মৃতিচারণ নয়, বরং নতুন রাজনৈতিক ঐক্য, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক সংস্কারের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। সে কারণেই এই দিনটিকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

শহীদ আবু সাঈদ: আন্দোলনের প্রতীক

অন্যদিকে, ১৬ জুলাইকে ‘শহীদ আবু সাঈদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। গত বছর রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। সেই সময়কার একটি শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনায় তার মৃত্যু ঘটে, যা গণআন্দোলনে ব্যাপক আলোড়ন তোলে।

আবু সাঈদের মৃত্যু সারা দেশের ছাত্র সমাজকে এক করে দেয়, যা পরবর্তীতে সরকার পতনের আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। সরকার তার স্মরণে ১৬ জুলাইকে শহীদ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে জাতিকে কৃতজ্ঞতা জানানোর পদক্ষেপ নিয়েছে।

আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও কর্মসূচি

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পরিপত্র অনুযায়ী, এই দুটি দিবস জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালনের ‘’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। এর মানে হলো—এগুলো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বসম্পন্ন দিবস হিসেবে চিহ্নিত এবং প্রতি বছর সরকারিভাবে পালিত হবে।

এই পরিপত্রে দেশের সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে দিবসদু’টি যথাযথ মর্যাদায় পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্কুল-কলেজ, সরকারি অফিস ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম আয়োজন করতে বলা হয়েছে।

৩৬ দিনব্যাপী ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ উদযাপন

৮ আগস্টের পটভূমিতে ঘটে যাওয়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে সরকার ৩৬ দিনব্যাপী একটি বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত (মাঝে কিছু দিন বিরতি দিয়ে) এই উদযাপন চলবে। এর সূচনা হবে ১ জুলাই ধর্মীয় উপাসনালয়ে শহীদদের স্মরণে দোয়া ও প্রার্থনার মাধ্যমে।

এই আয়োজনে দেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলোচনাসভা, প্রদর্শনী, মুক্ত আলোচনা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। দিবসগুলোকে ঘিরে তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিতর্ক, রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাও আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে।

জাতীয় উদযাপন কমিটি গঠন

এই উদযাপন কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে একটি ৩৬ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির সদস্য হিসেবে সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তারা অন্তর্ভুক্ত আছেন।

কমিটির সহসভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম। এছাড়া, সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পুরো কর্মসূচির সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন।

প্রধান উপদেষ্টার দফতর থেকে দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই আয়োজনের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র একটি সরকার পতনের ঘটনা উদযাপন নয়—বরং গণতন্ত্র, অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের আহ্বানকে সামনে আনা।

‘নতুন বাংলাদেশ’—একটি চেতনার নাম

ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্তর্বর্তী সরকার বারবার যে কথাটি বলছেন, তা হলো: “নতুন বাংলাদেশ কোনো ব্যক্তিগত অর্জনের বিষয় নয়, এটি একটি সম্মিলিত চেতনার নাম।” এই চেতনা শুধু রাজনৈতিক বদল নয়, বরং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, অর্থনৈতিক সমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাংস্কৃতিক জাগরণের ভিত্তি।

৮ আগস্ট তাই হয়ে উঠেছে একটি প্রতীকী দিন—যে দিন থেকে মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে দুর্নীতিমুক্ত, মানবিক ও সমঅধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্রের।

রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া

সরকারের এই ঘোষণা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। অধিকাংশ সংগঠন এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানালেও, কিছু সংগঠন প্রশ্ন তুলেছে দিবসের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে।

তবে সাধারণ নাগরিক সমাজ ও শিক্ষার্থীরা এই দিবসগুলোকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। অনেকেই বলছেন, “এই দিবসগুলো শুধু অতীতের স্মরণ নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য অঙ্গীকারের দিন।”

উপসংহার:

‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ এবং ‘শহীদ আবু সাঈদ দিবস’—এই দুটি দিবস দেশের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করল। এগুলো কেবল একটি রাজনৈতিক সময়কাল নয়, বরং পরিবর্তনের পেছনে থাকা ত্যাগ ও সাহসিকতার স্মারক। সরকার এই দিনগুলোর যথাযথ মর্যাদা রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করবে বলে আশা করা যায়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button