আঞ্চলিক

‘পলাতক’ হাসিনার পক্ষে লড়তে নিয়োগ পেলেন আইনজীবী

বাংলাদেশের ইতিহাসে আলোচিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ‘পলাতক’ দেখানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে আদালতে লড়ার জন্য একজন রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (২৪ জুন) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আইন মন্ত্রণালয় এ নিয়োগ দেয়। নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবী হলেন অ্যাডভোকেট আমির হোসেন, যিনি অতীতে স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ মামলায় দায়িত্ব পালন করেছেন।

এ বিষয়ে জানা গেছে, অ্যাডভোকেট আমির হোসেন ইতোমধ্যে মামলার যাবতীয় নথিপত্র বুঝে নিয়েছেন এবং পরবর্তী আইনি কার্যক্রমের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আইন মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনার মাধ্যমে তাঁকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়।

রাষ্ট্রীয় আইনজীবী নিয়োগের প্রেক্ষাপট

উল্লেখযোগ্য যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ চলতি বছরের ১ জুন শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযোগ আমলে নেয়। এতে বলা হয়, ২০২৫ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে সংঘটিত গণহত্যার ঘটনায় তাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। এই মামলায় অপর দুই আসামির একজন হচ্ছেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

১৬ জুন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ মামলার শুনানিকালে দুজন আসামিকে ‘পলাতক’ ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন। পত্রিকায় প্রকাশিত সেই বিজ্ঞপ্তিতে তাদের আদালতে হাজির হতে বলা হয়।

এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান কামালের বাসা এবং সম্ভাব্য অবস্থানস্থলগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে। তবে তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তদন্ত কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, তারা সম্ভবত বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা আদালতে হাজির না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল গতকাল এক আদেশে এই দুই আসামির পক্ষে রাষ্ট্রীয় আইনজীবী নিয়োগের নির্দেশ দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় অ্যাডভোকেট আমির হোসেনকে শেখ হাসিনার পক্ষে এবং আরেকজন আইনজীবীকে কামালের পক্ষে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

অ্যাডভোকেট আমির হোসেনের পটভূমি

অ্যাডভোকেট আমির হোসেন একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী হিসেবে সুপরিচিত। তিনি ২০০৯ সাল থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত স্পেশাল জজ আদালত-৮ এর স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং আইনি বিশ্লেষণ ক্ষমতার ওপর ভর করেই তাঁকে এই গুরুদায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

মামলার নথিপত্র বুঝে নেয়ার পর অ্যাডভোকেট আমির হোসেন বলেন, “আমি একজন পেশাদার আইনজীবী হিসেবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করব। আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক আমি মামলার সবদিক বিবেচনা করে যথাযথভাবে প্রতিনিধিত্ব করব।”

অভিযোগের ধরন ও প্রসিকিউশনের বক্তব্য

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আদালতে শুনানিতে বলেন, “জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত এই আসামিরা সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন, অথবা তাদের দায়িত্বহীনতার কারণে এমন ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।”

প্রসিকিউটর আরও জানান, শেখ হাসিনা ও কামালের বিরুদ্ধে দায়ের করা পাঁচটি অভিযোগের প্রতিটি মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়েছে। অভিযোগগুলো হলো: গণহত্যা, নির্যাতন, নির্বিচার হত্যা, আটক ও অপহরণ এবং মানবতা বিরোধী ষড়যন্ত্র। এসব অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে প্রত্যেক আসামির ভূমিকার আলোকে তৈরি করা হয়েছে।

১ জুন আদালতে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠনের সময় প্রধান প্রসিকিউটরসহ আরও দুইজন প্রসিকিউটর মিলে বিস্তারিতভাবে সব অভিযোগ আদালতে পড়ে শোনান, যা সে সময় দেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। সেই থেকেই মামলাটি জনসচেতনতায় বিশেষ স্থান দখল করে নেয়।

রাজনীতির কেন্দ্রে আইনি প্রক্রিয়া

দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং এক সময়ের ক্ষমতাসীন দলের নেত্রীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা নিঃসন্দেহে দেশের রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থা এবং জনগণের মনে নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মামলা বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও স্বাধীনতার এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে, তবে একই সঙ্গে এটি রাজনৈতিক উত্তেজনাও বাড়াতে পারে।

এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন মহল থেকে ইতোমধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া এসেছে। একপক্ষ এটিকে আইনের বিজয় বলে দেখছে, অন্যদিকে আরেকপক্ষ বলছে এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তবে আদালত এখনো মামলার বিস্তারিত শুনানি শুরু করেনি। সবকিছু নির্ভর করছে প্রাথমিক শুনানির পরবর্তী ধাপের ওপর।

পরবর্তী কার্যক্রম

ট্রাইব্যুনাল আগামী মাসে মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেছে। তার আগেই রাষ্ট্রীয় আইনজীবীরা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করবেন এবং মামলার কৌশল চূড়ান্ত করবেন। ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, আগামী শুনানিতে অভিযুক্তদের অনুপস্থিতির বিষয়ে আদালত পরবর্তী পদক্ষেপ বিবেচনা করবে, যার মধ্যে বিচার কার্যক্রম একতরফাভাবে পরিচালনার বিষয়টিও থাকতে পারে।

এদিকে, আন্তর্জাতিক মহলও এ মামলার দিকে নজর রাখছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মধ্যে কেউ কেউ বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার আহ্বান জানাচ্ছে।

এই মামলার পরিণতি যাই হোক না কেন, এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বিচারিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button