আঞ্চলিক

ইসরায়েলকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার আহ্বান বাংলাদেশের

ইসরায়েলের বেআইনি সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়ে দেশটিকে আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তুরস্কের ইস্তানবুলে অনুষ্ঠিত ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) ৫১তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে শনিবার দেওয়া এক বক্তব্যে তিনি এই আহ্বান জানান।

সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা স্পষ্টভাবে বলেন, ইসরায়েলের একতরফা ও বেপরোয়া সামরিক অভিযান কেবল ইরানের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এমন কার্যকলাপ পুরো মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে এবং বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, “আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইসরায়েল ইচ্ছেমতো আন্তর্জাতিক নীতিমালাকে উপেক্ষা করে একের পর এক উসকানিমূলক হামলা চালাচ্ছে। এই কর্মকাণ্ড যদি আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিহত না করা হয়, তাহলে এর প্রভাব গোটা বিশ্বের নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”

শান্তি ও কূটনীতির পথে ফিরে আসার আহ্বান

তৌহিদ হোসেন তার বক্তব্যে আরও বলেন, “এখনই সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একত্রিত হয়ে ইসরায়েলকে তার দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহিতার আওতায় আনার। শুধু নিন্দা নয়, প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপের।” তিনি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

তিনি উল্লেখ করেন, “আমরা চাই সংঘাত নয়, চাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। কিন্তু শান্তি তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

ফিলিস্তিনে চলমান হামলার বিরুদ্ধেও আহ্বান

ইরান ছাড়াও ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের সামরিক আগ্রাসনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা অবিলম্বে গাজা উপত্যকাসহ বিভিন্ন স্থানে এই অভিযান বন্ধের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “ফিলিস্তিনে শিশু, নারী ও নিরীহ মানুষের ওপর যে নির্মমতা চলছে তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের জঘন্য উদাহরণ। এই পরিস্থিতি বন্ধে ওআইসি-কে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।”

তিনি ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে আহ্বান জানান, যেন তারা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত (আইসিজে) এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)-এর মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে।

রোহিঙ্গা সংকট তুলে ধরেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

সম্মেলনে তৌহিদ হোসেন বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রোহিঙ্গা সংকটও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ মানবিক কারণে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। এই দীর্ঘমেয়াদী সংকটের সমাধান না হলে এটি আমাদের জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকির কারণ হবে।”

তিনি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপ আরও জোরদার করার পাশাপাশি, আইসিজেতে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়ায় ওআইসির সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সক্রিয় অর্থায়নের আহ্বান জানান।

রোহিঙ্গা সংকটকে ওআইসি টেন ইয়ার প্রোগ্রাম অব অ্যাকশনের অন্যতম কৌশলগত অগ্রাধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তিনি ওআইসি সচিবালয় ও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

ইসলামভীতি ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপের তাগিদ

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মুসলিম বিশ্বের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও ইসলামফোবিয়ার ক্রমবর্ধমান হুমকির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “ইসলামভীতির বিরুদ্ধে আমাদের জোরালো অবস্থান নিতে হবে এবং মুসলিম সমাজের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “ওআইসি শুধু একটি প্রতিক্রিয়াশীল সংস্থা হিসেবে নয়, বরং এটি যেন হয়ে ওঠে বাস্তবায়নমুখী এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী একটি সংগঠন—সে লক্ষ্যে আমাদের কাজ করতে হবে।”

গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক বৈঠক

সম্মেলনের সাইডলাইনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাতো সেরি উটামা হাজি মোহাম্মদ বিন হাজি হাসান, ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুয়াদ হোসেন, উজবেকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইদভ বাখতিয়র ওদিলোভিচ এবং পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সঙ্গে বৈঠক।

বৈঠকগুলোতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়ন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণ এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।

ওআইসি সম্মেলনের পটভূমি

ওআইসির ৫১তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলন শনিবার ইস্তানবুলে শুরু হয়। সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তব্য দেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও সংহতির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

সম্মেলনের বিশেষ অধিবেশনে ইরানের ওপর ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসন এবং ফিলিস্তিনের চলমান মানবিক সংকটকে কেন্দ্র করে আলোচনা হয়। ওআইসির পক্ষ থেকে একটি যৌথ বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানানো হয়।

উপসংহার

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের বক্তব্য শুধু নীতিগত অবস্থান নয়, বরং এটি এক আন্তরিক আন্তর্জাতিক আহ্বান—যেখানে শান্তি, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ হবার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই বার্তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, বিশেষত যখন আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button