আঞ্চলিক

সাবেক সিইসিদের নামে মামলা করবে বিএনপি

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী তিনজন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)—কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, কে এম নূরুল হুদা এবং কাজী হাবিবুল আউয়ালের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দলটির অভিযোগ, এই তিনজনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন দেশজুড়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে এবং ভোটারদের অধিকার হরণ করেছে।

দলটির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান শনিবার (২১ জুন) এই তথ্য গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, আগামীকাল রোববার (২২ জুন) বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে মামলার কপি জমা দেবে এবং পরে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের করবে।

প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে সালাহউদ্দিন আহমেদ

জানা গেছে, মামলার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গঠিত হয়েছে। সকাল পৌনে ১১টায় তারা শেরেবাংলা নগর থানায় গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মামলার আবেদন জমা দেবেন।

শায়রুল কবির খান বলেন,

বিগত নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী সিইসিরা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের নামে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছেন। তারা একপক্ষীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করে গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছেন। তাই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া সময়ের দাবি।”

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পদক্ষেপ

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে আগের সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সম্ভাব্য অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে পক্ষপাতমূলক ভূমিকা পালন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এই তিনটি নির্বাচন যথাক্রমে অনুষ্ঠিত হয়েছিল:

  • ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন: তৎকালীন সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি অংশ নেয়নি এবং অধিকাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়ী হন।
  • ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: সিইসি কে এম নূরুল হুদার অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে নির্বাচনের দিন সকাল থেকেই কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই ও ফলাফল জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে।
  • ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের তত্ত্বাবধানে হয়, যে নির্বাচনেও বিরোধী জোটের ব্যাপক অনুপস্থিতি এবং ভোটার উপস্থিতির অভাব ছিল লক্ষ্যণীয়।

নির্বাচন কমিশনের নিরবতা

বিএনপির এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে ইসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান,

“বিষয়টি এখনো আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে পাইনি। যেহেতু এটি একটি আইনগত বিষয়, সেহেতু কমিশন মামলার কপি পাওয়ার পর আইনি পরামর্শ গ্রহণ করে পদক্ষেপ নেবে।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া

নির্বাচনী বিশ্লেষক এবং রাজনীতি বিষয়ক গবেষকরা বলছেন, এই মামলার রাজনৈতিক প্রভাব যথেষ্ট গুরুতর হতে পারে। সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে মামলা দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রের ওপর জনগণের আস্থাকে নতুনভাবে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদুল হক বলেন,

“এই মামলা শুধু একটি দলের উদ্যোগ নয়, বরং তা পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থার জবাবদিহিতার দাবি। তবে এটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলার সুযোগ থাকলেও, তদন্তে যদি সত্যতা পাওয়া যায়, তবে তা ভবিষ্যতের নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হবে।”

বিএনপির দাবির পেছনের যুক্তি

বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছে যে, বর্তমান ও আগের নির্বাচন কমিশনগুলো ক্ষমতাসীন সরকারের নির্দেশে কাজ করেছে। তাদের অভিযোগ, কমিশন কখনোই একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারেনি। নির্বাচনের সময় বিরোধী দলের প্রার্থীদের প্রার্থিতা বাতিল, গ্রেপ্তার, হয়রানি ও ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোটারদের বাধা দেওয়া ছিল সাধারণ চিত্র।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন,

“আমরা চাই, জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা হোক। যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই অধিকারের ওপর চরম আঘাত হেনেছে, তাদের বিরুদ্ধে বিচার হোক। এই মামলা সেই প্রক্রিয়ার সূচনা মাত্র।”

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

আওয়ামী লীগ এই মামলার বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেয়নি। তবে দলটির একাধিক নেতারা গণমাধ্যমে ইঙ্গিত দিয়েছেন, বিএনপি রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়ে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছে এবং বিচারব্যবস্থাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চাইছে।

আইনি দিক ও সম্ভাব্য প্রভাব

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে মামলা হলে সেটি বিচারব্যবস্থায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে। তবে প্রমাণ ও সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের মামলার বিচারিক অগ্রগতি সহজ হবে না।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন,“যদি যথাযথভাবে অভিযোগ আনা হয় এবং নিরপেক্ষ তদন্ত হয়, তাহলে তা দেশের জন্য ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হতে পারে। তবে রাজনৈতিক মামলার ক্ষেত্রে বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার ঝুঁকি সবসময় থেকেই যায়।”

উপসংহার

সাবেক সিইসিদের বিরুদ্ধে বিএনপির এই মামলা দেশের রাজনৈতিক ও নির্বাচন ব্যবস্থায় বড় ধরনের আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে। এটি শুধুই প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির অংশ, নাকি গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার রক্ষায় একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ—তা সময়ই বলে দেবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button