আঞ্চলিক

ঢামেকের ওসিসির বাথরুমের ভেন্টিলেটর ভেঙে পালালো কিশোরী

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ-ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) থেকে পালিয়ে গেছে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরী, যার নাম ফাতেমা। শনিবার (২১ জুন) বিকাল পাঁচটার দিকে ওসিসির বাথরুমের ভেন্টিলেটর ভেঙে পালানোর এই ঘটনা ঘটে।

ফাতেমা রাজধানীর খিলগাঁও থানার একটি অপহরণ মামলার ভিকটিম হিসেবে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য ওসিসিতে ভর্তি ছিলেন। তবে হঠাৎ করেই সে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায়। ঘটনার পরপরই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা থানায় অবহিত করেন।

ঘটনাস্থল থেকে পালানো ও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া

ওসিসির দায়িত্বরত চিকিৎসক তইয়্যাবা সুলতানা জানান, “শুক্রবার (২০ জুন) খিলগাঁও থানা পুলিশ ফাতেমাকে আমাদের ওসিসিতে নিয়ে আসে। শনিবার বিকালে সে বাথরুমে যায় এবং দীর্ঘ সময় দরজা না খোলায় সন্দেহ হয়। পরে জোর করে দরজা খোলা হলে দেখা যায়, সে বাথরুমের ভেন্টিলেটরের গ্লাস খুলে পালিয়ে গেছে।”

তিনি আরও বলেন, “পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা ঘটনাটি খিলগাঁও থানায় জানাই, যাতে তারা দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারেন।”

পুলিশের বক্তব্য ও মামলার পটভূমি

খিলগাঁও থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবু সায়েম জানান, “গতকাল আমাদের থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের হয়েছিল। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ফাতেমাকে খিলগাঁওয়ের এক বাড়ি থেকে উদ্ধার করি। উদ্ধারের পর তার শারীরিক ও ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়।”

তিনি বলেন, “শনিবার সন্ধ্যায় আমরা জানতে পারি সে হাসপাতাল থেকে ভেন্টিলেটর ভেঙে পালিয়ে গেছে। এ ঘটনায় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে।”

প্রেমের সম্পর্ক ও মামলা

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ফাতেমার সঙ্গে খিলগাঁওয়ের পাশের বাড়ির যুবক ফয়সালের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কয়েক দিন আগে সে ফয়সালের বাসায় গিয়ে অবস্থান করছিল। পরিবার বিষয়টি জানতে পারলে পুলিশি সহায়তায় তাকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

কিন্তু ফাতেমা আবারও ফয়সালের বাসায় চলে যায়। এ অবস্থায় ফাতেমার বাবা ও ভাই খিলগাঁও থানায় ফয়সাল ও তার পরিবারের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগে মামলা করেন।

এসআই সায়েম বলেন, “ওই মামলার ভিত্তিতে আমরা ফাতেমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠাই। বর্তমানে পালানোর বিষয়টি তার পরিবারকে জানানো হয়েছে এবং তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।”

ওসিসি’র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন

এই ঘটনার পর ওসিসির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, কীভাবে একটি কিশোরী নিরাপত্তা বলয় ভেঙে এভাবে পালাতে সক্ষম হয়? কেন বাথরুমের মতো স্পর্শকাতর স্থানে পর্যাপ্ত নজরদারি ছিল না?

ওসিসির একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “সাধারণত ওসিসিতে থাকা মেয়েদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত থাকে। তবে প্রতিটি বাথরুমের সামনে সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখা হয় না। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই সে পালিয়ে থাকতে পারে।”

বিশেষজ্ঞদের মত

অপরাধ ও সামাজিক গবেষক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, “এই ধরণের কিশোরীদের যথাযথ মনোসমর্থন, কাউন্সেলিং এবং নজরদারি ছাড়া ওসিসিতে রাখা বিপজ্জনক হতে পারে। অনেকে মানসিক চাপে ভোগে, কেউ কেউ আত্মরক্ষার অভিপ্রায়ে বা আবেগে এমন পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।”

তিনি যোগ করেন, “সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উচিত এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা এবং কিশোরীদের জন্য আলাদা মনোসামাজিক সহায়তা দল গঠন করা।”

আগাম সতর্কতা ও প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়া

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই ঘটনার পর হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও কড়াকড়ি করা হয়েছে। ওসিসির প্রতিটি ঘরের জানালা ও ভেন্টিলেটরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনরায় পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

এছাড়া, ভবিষ্যতে কিশোরী ও কিশোরদের হেফাজতে রাখার সময় অতিরিক্ত নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগের প্রস্তাবও ভাবা হচ্ছে।

একজন হাসপাতাল কর্মকর্তা বলেন, “এই ঘটনাটি আমাদের জন্য একটি বড় শিক্ষা। আমরা প্রশাসনিকভাবে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছি এবং ওসিসির নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছি।”

সামাজিক প্রতিক্রিয়া

ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ বলছেন, প্রেমের সম্পর্ক থেকে কিশোরীদের এমন ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তের পেছনে পারিবারিক নিপীড়ন বা অনিরাপত্তা কাজ করে। আবার কেউ বলছেন, পুলিশি ও হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঢিলেঢালা মনোভাবের কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে।

একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী মন্তব্য করেন, “১৪ বছরের মেয়েকে যদি আমরা নিরাপদভাবে রাখতেই না পারি, তবে অপরাধ ভিকটিমদের জন্য আলাদা সেবা কেন্দ্র থাকার উদ্দেশ্যই কি?”

উপসংহার

ওসিসি থেকে কিশোরী ফাতেমার পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং সমাজের জন্য একটি বড় সতর্ক সংকেত। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজন যৌথ পদক্ষেপ—বিশেষত কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও সামাজিক সহায়তা নিশ্চিত করার দিকেই জোর দিতে হবে।

এ বিষয়ে আরও তদন্ত চলছে এবং পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দ্রুতই ফাতেমাকে খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা নেওয়া হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button