আঞ্চলিক

পুলিশকে কামড় দিয়ে ঢাকার আদালত থেকে পালালেন খুনের আসামি

ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যেই ঘটেছে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা—ছয় বছর ধরে কারাবন্দী এক খুনের আসামি পুলিশ সদস্যকে কামড় দিয়ে পালিয়ে গেছেন। ঘটনাটি বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) দুপুরে ঘটে। পালিয়ে যাওয়া আসামির নাম শরীফুল ইসলাম, যিনি রাজধানীর খিলগাঁও থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলার প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মাইন উদ্দিন চৌধুরী ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, ‘‘আসামি শরীফুল ইসলাম আজ দুপুরে আদালতে শুনানির জন্য কারাগার থেকে আনা হয়েছিল। শুনানি শেষে তাঁকে যখন আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন সে হঠাৎ পুলিশ কনস্টেবল শহীদুল ইসলামের হাতে কামড় দিয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়।’’

এই ঘটনা আদালত চত্বরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি প্রশ্ন তুলেছে। মামলার মতো গুরুত্বপূর্ণ আসামি পুলিশের নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে কীভাবে পালাতে সক্ষম হলো, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট মহল।

আসামি শরীফুল ইসলাম কে?

শরীফুল ইসলাম (৩৪) দিনাজপুর জেলার হরিপুর গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর বাবার নাম শফিক আহমেদ। পুলিশ জানায়, ২০১৮ সালে খিলগাঁও থানায় দায়ের হওয়া একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন শরীফুল। মামলার পর থেকে তিনি ছয় বছর ধরে কারাগারে বন্দি ছিলেন। তাঁকে বেশ কয়েকবার আদালতে হাজির করা হলেও এরকম কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা অতীতে ঘটেনি।

কীভাবে ঘটলো পলায়নের ঘটনা?

প্রত্যক্ষদর্শী ও আদালতের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সূত্র জানায়, দুপুর ২টার দিকে শরীফুলের শুনানি শেষ হয়। এরপর পুলিশ সদস্য শহীদুল ইসলাম তাঁর দায়িত্বে তাঁকে হাজতখানায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানেই আচমকা শরীফুল কনস্টেবল শহীদুলের হাতে কামড় দেন এবং দ্রুতগতিতে দৌঁড়ে আদালত প্রাঙ্গণ ছাড়েন।

নিরাপত্তারক্ষীরা তৎক্ষণাৎ ধাওয়া করলেও শরীফুলকে আর ধরা সম্ভব হয়নি। আদালত চত্বর ও আশেপাশের এলাকায় পুলিশের চিরুনি অভিযান শুরু হলেও এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত শরীফুলকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

তদন্ত কমিটি গঠন

ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে দেখা হবে, কনস্টেবল শহীদুল ইসলাম তাঁর দায়িত্ব পালনে কোনো অবহেলা করেছেন কি না।

এডিসি মাইন উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘‘আসামি পালিয়ে যাওয়ার পেছনে কারও গাফিলতি থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমন ঘটনা কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না।’’

নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি?

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আদালতের মতো একটি সংবেদনশীল এলাকায় হত্যার মতো মামলার আসামির পলায়ন আদালত প্রাঙ্গণের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বড় ব্যর্থতা। বাংলাদেশে বিচারকার্য চলাকালীন সময়ে আসামিদের পালানোর ঘটনা নতুন নয়, তবে এমন পরিকল্পিত ও সাহসী পলায়ন নজিরবিহীন বলেই অভিহিত করছেন অনেকে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম বলেন, ‘‘আদালতে পুলিশের উপস্থিতিতেই খুনের আসামির পালিয়ে যাওয়া চরম নিরাপত্তা ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়। এটি বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমিয়ে দিতে পারে।’’

পুলিশের দায় ও চ্যালেঞ্জ

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ, একটি নিরাপদ পরিবেশে আসামির উপস্থিতি নিশ্চিত করা পুলিশের অন্যতম দায়িত্ব। পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে আদালত প্রাঙ্গণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

এছাড়া কারাগার থেকে আদালতে আসামি পরিবহনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ, হাতকড়া ও দেহ তল্লাশি পদ্ধতিকে আরও কড়াকড়ি করা হবে বলেও জানানো হয়।

জনমনে প্রশ্ন ও প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই পুলিশের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ দাবি করছেন, এ ধরণের ঘটনার পেছনে প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাও থাকতে পারে।

নগরবাসীর একজন, সায়েদাবাদের বাসিন্দা রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘‘একজন খুনের আসামি যদি আদালতের ভেতর থেকেই পালাতে পারে, তাহলে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়? যারা আদালতেও নিরাপদ না, তারা সমাজে কেমন বিপদজনক হতে পারে তা ভাবতেই ভয় লাগে।’’

গ্রেপ্তারে অভিযান

ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শরীফুল ইসলামকে ধরতে রাজধানীসহ আশেপাশের জেলাগুলোতে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। দিনাজপুরের হরিপুর এলাকাতেও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও শরীফুলকে ধরার কাজে সহায়তার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ডিএমপির পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, অতি দ্রুত শরীফুলকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।

উপসংহার

আদালত থেকে একজন খুনের আসামির এমন নাটকীয় পালিয়ে যাওয়া ঘটনাটি দেশের বিচার ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি একটি বড় ধাক্কা। এই ঘটনা একদিকে যেমন পুলিশের নিরাপত্তা ও তদারকির ঘাটতির দিকটি উন্মোচন করে, অন্যদিকে তা দেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আরও দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি তুলে ধরে।

জনগণ আশা করছে, এই ঘটনার পূর্ণ তদন্তের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং একইসাথে ভবিষ্যতে এমন নিরাপত্তা ঝুঁকি রোধে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button