ত্মরক্ষার কৌশল শেখাতে কোর্স চালু করল চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দায়িত্ব পালনে আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে আত্মরক্ষা প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করেছে। মঙ্গলবার (১৭ জুন) বিকেলে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ লাইন্সে অবস্থিত সিভিক সেন্টারে আনুষ্ঠানিকভাবে এ কোর্সের উদ্বোধন করা হয়। জেলা পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম সানতু এই কোর্সের উদ্বোধন করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পুলিশ সুপার বলেন, “বর্তমান বাস্তবতায় পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পালনের সময় বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হয়। তাই শারীরিকভাবে সক্ষম হওয়া এবং মানসিক দৃঢ়তা অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি। আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে মার্শাল আর্ট একটি কার্যকর পন্থা। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমাদের সদস্যরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করার সময় যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে।”
প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হচ্ছে, পুলিশের মাঠপর্যায়ের সদস্যদের এমনভাবে প্রস্তুত করা, যাতে তারা হঠাৎ করে কোনো সহিংস বা আক্রমণাত্মক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে তাৎক্ষণিকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং আত্মরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া জানাতে সক্ষম হন। পুলিশের পেশাগত জীবনে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি ও হুমকি প্রতিনিয়তই বিদ্যমান। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, সহিংস জনতা কিংবা হঠাৎ বিস্ফোরণ—এসব পরিস্থিতি মোকাবেলায় কেবল অস্ত্র বা সরঞ্জাম নির্ভর না থেকে ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার কৌশল জানা জরুরি হয়ে পড়ে।
পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, “এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা পুলিশ সদস্যদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে চাই। একজন সদস্য যখন জানবেন যে, নিজের শরীর দিয়েই নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব, তখন তার দায়িত্ব পালনে আরও দৃঢ়তা আসবে। পাশাপাশি এটি তাদের মনস্তাত্ত্বিক দৃঢ়তাও বাড়াবে।”
প্রশিক্ষণের কাঠামো ও পরিচালনা
এই কোর্সটি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ‘চিটাগাং চাইনিজ মার্শাল আর্ট উশু একাডেমি’। একাডেমিটির প্রধান প্রশিক্ষকসহ বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক এই কোর্সে পাঠদান করছেন। প্রশিক্ষণের সময়সূচি ও কাঠামো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে এটি নিয়মিত পুলিশি দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়। প্রতিদিন নির্ধারিত সময় ধরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং এতে ব্যালান্স বজায় রাখা হবে কর্মদায়িত্ব ও দক্ষতা অর্জনের মধ্যে।
কোর্সে আত্মরক্ষামূলক বিভিন্ন মার্শাল আর্ট টেকনিক, দ্রুত প্রতিক্রিয়ার কৌশল, অস্ত্রহীন আত্মরক্ষার উপায়, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং মানসিক দৃঢ়তা বৃদ্ধির উপরে জোর দেওয়া হচ্ছে।
প্রশিক্ষণের প্রথম ধাপে এক ব্যাচে প্রায় ৩০-৫০ জন সদস্য অংশ নিচ্ছেন। পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের সব সদস্যকে এই প্রশিক্ষণ প্রদানের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার।
প্রশিক্ষণ অংশগ্রহণকারীদের অভিমত
প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া এক কনস্টেবল বলেন, “প্রতিদিন মাঠে কাজ করার সময় হঠাৎ করে যে কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আগে এসব পরিস্থিতি সামলাতে কেবল অস্ত্রের দিকেই নির্ভর করতাম। এখন বুঝতে পারছি, নিজের শরীর দিয়েই অনেক কিছু রক্ষা করা সম্ভব।”
আরেক নারী পুলিশ সদস্য বলেন, “নারী সদস্যদের জন্য এমন প্রশিক্ষণ অনেক দরকারি। আমরা বিভিন্ন সময়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে দায়িত্ব পালন করি। অনেক সময় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে গেলে নিজেকে রক্ষা করাও জরুরি হয়ে পড়ে। এই প্রশিক্ষণ আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে।”
প্রশিক্ষণের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই কোর্সটিকে একটি চলমান ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ভবিষ্যতে জেলার অন্যান্য পুলিশ ইউনিট যেমন ট্রাফিক বিভাগ, গোয়েন্দা বিভাগসহ সব ইউনিটকে এই প্রশিক্ষণের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
পুলিশ সুপার আরও জানিয়েছেন, প্রশিক্ষণ কোর্সটির মূল্যায়ন এবং সফলতা যাচাইয়ের জন্য আলাদা একটি কমিটি গঠন করা হবে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যদের মাঠপর্যায়ে পারফরম্যান্স মূল্যায়নের ভিত্তিতে এই প্রশিক্ষণের প্রভাব বিশ্লেষণ করা হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী ভবিষ্যতে কোর্সের পরিধি ও বিষয়বস্তুতেও পরিবর্তন আনা হতে পারে।
প্রশিক্ষণ ও পেশাদারিত্বের সেতুবন্ধন
বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিটি সদস্যকে আধুনিক, দক্ষ ও পেশাদার হিসেবে গড়ে তুলতে এই আত্মরক্ষা প্রশিক্ষণ একটি সময়োপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে শুধু অস্ত্র বা প্রযুক্তিনির্ভরতা নয়, বরং মানবিক বুদ্ধিমত্তা, শারীরিক ফিটনেস এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীলতা—এই তিন উপাদানকে গুরুত্ব দিয়ে পুলিশের সক্ষমতা বাড়ানোর কৌশলই এখন সময়ের দাবি।
পুলিশি কার্যক্রমে পেশাদারিত্ব ও জনবিশ্বাস নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম। আত্মরক্ষার মাধ্যমে একজন পুলিশ সদস্য নিজেকে সুরক্ষিত রাখার পাশাপাশি জনগণেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেন আরও দক্ষতার সঙ্গে। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের এই পদক্ষেপ সারা দেশের জন্যই একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে।