আঞ্চলিক

বৈঠকে যোগ দেয়নি জামায়াত, ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনে একমত বাকি দলগুলো

জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সর্বশেষ বৈঠকে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে ৩০টি রাজনৈতিক দল। এই সংশোধনের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারের পথ উন্মুক্ত হচ্ছে, তবে অর্থবিল ও আস্থা ভোটের ক্ষেত্রে দলীয় শৃঙ্খলা বজায় থাকবে।

মঙ্গলবার (১৭ জুন) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত বৈঠকে এই ঐকমত্য গড়ে ওঠে। সকাল সাড়ে ১১টায় শুরু হওয়া বৈঠকে জামায়াতে ইসলামী অংশ নেয়নি। তাদের প্রতিনিধিদের জন্য ৩০ মিনিট অপেক্ষা করা হলেও শেষ পর্যন্ত তারা বৈঠকে যোগ দেয়নি। জানা গেছে, সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক নিয়ে যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ হয়, তা নিয়ে জামায়াত অসন্তোষ প্রকাশ করে। সেই অসন্তোষের প্রতিক্রিয়ায় তারা এই বৈঠক বয়কট করে বলে দলটির অনানুষ্ঠানিক সূত্রে জানা যায়।

৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন : সংসদে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা

বৈঠকে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের বিষয়টি। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো সংসদ সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বিপরীতে ভোট দিলে তাঁর সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়। বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজ দীর্ঘদিন ধরেই এই অনুচ্ছেদের কঠোরতা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিল। অবশেষে কমিশনের বর্তমান প্রস্তাবে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র অর্থবিল এবং সরকারের আস্থাভোট ছাড়া অন্যান্য সকল বিষয়ে সংসদ সদস্যরা নিজস্ব মত প্রকাশ করতে পারবেন। ফলে সংসদে মতবিনিময় ও বিতর্কের ক্ষেত্র প্রসারিত হবে।

বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক অভাবনীয় ঐকমত্য গড়ে উঠেছে। এটি একটি বড় অগ্রগতি। এর মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত আরও শক্ত হবে।”

নারী আসন দ্বিগুণ করার প্রস্তাব

বৈঠকে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করার প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছে। তবে এই আসনগুলোতে কীভাবে নির্বাচন হবে, তা নিয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, “আমরা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নারী আসনে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছি। অনেকে এতে একমত, তবে কিছু দল আপত্তি জানিয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো জরুরি, তবে তা যেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই হয়—এমনটাই আমাদের অবস্থান।”

সংসদীয় কমিটিতে বিরোধীদলের অংশগ্রহণ

বৈঠকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো নিয়ে। বৈঠকে অংশ নেওয়া দলগুলো একমত হয়েছে যে, কমপক্ষে চারটি গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদ বিরোধীদলের কাছে থাকবে। এছাড়া, প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে অন্য কমিটিগুলোর অর্ধেকেও বিরোধীদলীয় সদস্যরা সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, “এটি বিরোধীদলগুলোর অংশগ্রহণমূলক ও জবাবদিহিমূলক সংসদ গঠনের পথে বড় পদক্ষেপ। ক্ষমতার ভারসাম্য ও জনঅংশগ্রহণের জন্য এমন পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

উচ্চকক্ষ গঠন নিয়ে দ্বিমত

সংসদের কাঠামো সংস্কারের অংশ হিসেবে উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়টিও আলোচনায় আসে। বিএনপি তাদের ৩১ দফার আলোকে উচ্চকক্ষে ১০০ আসন রাখার প্রস্তাব দেয়। যদিও অনেক দল এ বিষয়ে একমত হয়েছে, তবুও নির্বাচন পদ্ধতি ও ক্ষমতার পরিসীমা নিয়ে এখনও মতানৈক্য রয়ে গেছে।

বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, “দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হবে এবং আইন প্রণয়নে আরও গভীর আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হবে।”

প্রধান বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত করার প্রস্তাব

প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা সীমিত করার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। বিএনপি প্রস্তাব দেয়, রাষ্ট্রপতিকে কিছু নির্দিষ্ট যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়ার বিধান রাখা হোক। এতে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল একমত হলেও দুটি দল এখনও ভিন্নমত পোষণ করছে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এ ধরনের সংবিধানিক সংস্কার অপরিহার্য।”

জামায়াতের অনুপস্থিতি ও ভবিষ্যৎ বৈঠক

জামায়াতে ইসলামী মঙ্গলবারের বৈঠকে অংশ না নিলেও আগামীকাল থেকে তারা বৈঠকে যোগ দেবে বলে জানিয়েছে কমিশন। আলী রীয়াজ জানান, “সব দলের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। আলোচনার মাধ্যমেই আমরা একমতের ভিত্তিতে জুলাই মাসের মধ্যে চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করতে পারব বলে আশাবাদী।”

তিনি আরও বলেন, “ঐকমত্য না হলে গণতন্ত্র এগোয় না। আমরা ধাপে ধাপে আলোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাই।”

ভবিষ্যৎ পথরেখা

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই বৈঠক রাজনৈতিক সংস্কারের পথে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জুলাই মাসের মধ্যে একটি চূড়ান্ত ‘জুলাই সনদ’ প্রকাশের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কর্মকৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এ ধরনের ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, জবাবদিহিমূলক ও কার্যকর সংসদ গঠনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত রাখা গেলে আগামী দিনের গণতন্ত্র আরও দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button