আঞ্চলিক

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ২০ টাকা কেজির আম ঢাকায় ৮০ টাকা

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট বাজার, যা দেশের বৃহত্তম আমের বাজার হিসেবে পরিচিত, এখন হিমসাগর আমের ভরা মৌসুমে সরগরম। তবে এই বাজারের জমজমাট ব্যবসা ও আমের মিষ্টি ঘ্রাণের মাঝেও আমচাষিদের মুখে হাসি নেই। কারণ, তারা প্রত্যাশিত দাম থেকে অনেক কম মূল্যে আম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কানসাট বাজারে হিমসাগর আমের গড় মূল্য প্রতি কেজি ২০ টাকা, যা মানভেদে ১৬ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। কিন্তু ঢাকার বাজারে এই একই আম বিক্রি হচ্ছে গড়ে ৮০ টাকা কেজি দরে, কোথাও কোথাও ৬০-৭০ টাকাতেও। এই বিশাল দামের ব্যবধানের পেছনে পরিবহন খরচ, মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা এবং বাজারের চাহিদার ওঠানামা কাজ করছে। তবে আমচাষিরা বলছেন, এই ব্যবধানের সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত তারাই।

কানসাট বাজারের জমজমাট চিত্র

গত বৃহস্পতিবার কানসাট বাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শত শত ভ্যানগাড়িতে আমচাষিরা আম নিয়ে হাজির হচ্ছেন। বাজারের আশপাশের গলিপথে প্লাস্টিকের ক্যারেট আর বাঁশের ঝুড়িতে আমের স্তূপ। শিকারপুর, মোবারকপুর, বাজিতপুরসহ আশপাশের এলাকা থেকে আমচাষিরা ভোর থেকে আম নিয়ে বাজারে আসছেন। বাজারের মূল সড়কে প্রতিদিন এক থেকে দুই কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। শতাধিক ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান দেশের বিভিন্ন জেলায় আমের চালান নিতে কানসাটে আসছে। কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবসাও এখন জমজমাট।

কানসাট বাজারে আমের আড়তগুলোতে সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত ব্যবসা চলে। আড়তদারেরা আমচাষিদের কাছ থেকে আম কিনছেন, আর ক্রেতারা আমের মিষ্টি গন্ধে মুগ্ধ হয়ে কেনাকাটা করছেন। বিকেলের দিকে বেচাকেনা কিছুটা কমলেও সকাল থেকে বাজারে ভিড় থাকে অবিরাম। হিমসাগর আমের পাশাপাশি ল্যাংড়া এবং অন্যান্য জাতের আমও বাজারে উঠতে শুরু করেছে।

আমের দামের হিসাব

কানসাট বাজারে আমের দাম নির্ধারণ হয় মণ হিসেবে, যেখানে ৫০ কেজি এক মণ ধরা হয়। তিন ধরনের আমের দাম প্রচলিত আছে। যেসব আম চার-পাঁচ দিন পর পাকবে, সেগুলোর দাম প্রতি মণ ১,৫০০ থেকে ২,০০০ টাকা, অর্থাৎ কেজিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। দুই-তিন দিনের মধ্যে পাকা আমের দাম প্রতি মণ ১,০০০ থেকে ১,৫০০ টাকা, অর্থাৎ কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা। এই ধরনের আমের বেচাকেনা সবচেয়ে বেশি। আর একেবারে পাকা আমের দাম প্রতি মণ ৮০০ থেকে ১,০০০ টাকা, যা কেজিতে ১৬ থেকে ২০ টাকা। বিক্রেতারা জানান, পাকা আম দ্রুত পচে যাওয়ার ভয়ে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আমের আকার ও জাতভেদেও দামের ওঠানামা হয়।

কানসাটের আমচাষি গোলাম মোস্তফা বলেন, “ঈদের লম্বা ছুটির কারণে আমের বেচাকেনা কম হয়েছে। গরমের কারণে আম দ্রুত পেকে যাচ্ছে, আর চাহিদাও কম। ফলে লোকসান এড়াতে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।” তিনি আরও জানান, প্রত্যাশিত দাম না পাওয়ায় অনেক চাষি হতাশ।

পরিবহন খরচ ও বাজারের ব্যবধান

কানসাট থেকে ঢাকায় আম পাঠানোর জন্য কুরিয়ার সার্ভিসে প্রতি কেজি খরচ পড়ে ১২ টাকা। চট্টগ্রামের মতো দূরবর্তী এলাকায় খরচ ১৬ টাকা। সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে ঢাকায় হোম ডেলিভারির জন্য খরচ ২০ টাকা। পাইকারি ব্যবসায়ীরা ট্রাক ভাড়া করে আম পাঠালে খরচ আরও কম, প্রতি কেজিতে ৪ টাকা। তবে ক্যারেটের দাম (১৬০-১৮০ টাকা) যোগ করলে কেজিতে খরচ হয় ৭ টাকা। ফলে কানসাটে ২০ টাকা কেজির আম ঢাকায় পৌঁছাতে মোট খরচ পড়ে ৩২ টাকা।

কিন্তু ঢাকার কারওয়ান বাজারে হিমসাগর আম বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি, মানভেদে ৬০-৭০ টাকাও। উত্তরা, মহাখালী, মিরপুরের বাজারেও দাম ৭০-৮০ টাকা। অনলাইনে হোম ডেলিভারিসহ দাম ১০০-১১০ টাকা। এই বিশাল দামের ব্যবধানের পেছনে মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা, বাজারের চাহিদা এবং খুচরা বিক্রেতাদের মুনাফা উল্লেখযোগ্য।

আমচাষিদের হতাশা

কানসাটের আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদের ছুটি ও অতিরিক্ত গরমের কারণে আমের চাহিদা কমেছে। ফলে দামও কম। এদিকে পরিবহন খরচ ও মধ্যস্থতাকারীদের মুনাফার কারণে ঢাকার বাজারে দাম বেড়ে যাচ্ছে। আমচাষি গোলাম মোস্তফা বলেন, “আমরা কেজিতে ২০ টাকা পাই, আর ঢাকায় বিক্রি হয় ৮০ টাকায়। এই টাকা কোথায় যায়, আমরা জানি না। আমাদের লাভের অংশ খুবই কম।”

ব্যবসায়ীদের মতে, কানসাট থেকে প্রতিদিন কয়েক শ টন আম দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের প্রতিনিধিরাও কানসাট থেকে আম কিনে কুরিয়ারে পাঠাচ্ছেন। এ ছাড়া পর্যটকরাও কানসাটে এসে আম কিনছেন। মোতাহারুল ইসলাম নামে এক ক্রেতা জানান, তিনি ২০-২৫ টাকা কেজি দরে আম কিনে কুরিয়ারে আত্মীয়দের কাছে পাঠিয়েছেন।

সমাধানের পথ কী?

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষিরা মনে করেন, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি, মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা কমানো এবং সরাসরি বাজারজাতকরণের সুযোগ বাড়ালে তারা ন্যায্য দাম পেতে পারেন। কৃষি বিভাগের সহায়তায় আমচাষিদের জন্য সরাসরি বিক্রয় কেন্দ্র বা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে। এতে চাষিরা তাদের উৎপাদিত আমের ন্যায্য মূল্য পাবেন, এবং ভোক্তারাও কম দামে আম কিনতে পারবেন।

উপসংহার

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট বাজার দেশের আমের রাজধানী হিসেবে খ্যাত। কিন্তু আমচাষিরা যখন তাদের কষ্টের ফসলের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তখন এই খ্যাতি তাদের জন্য সান্ত্বনা হয়ে দাঁড়ায় না। ঢাকার বাজারে চার গুণ দামে আম বিক্রি হলেও চাষিদের হাতে আসছে নগণ্য অংশ। সরকার, কৃষি বিভাগ এবং ব্যবসায়ীদের সমন্বিত উদ্যোগে এই ব্যবধান কমানো গেলে আমচাষিরা তাদের শ্রমের প্রকৃত মূল্য পাবেন।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button