সিরাজগঞ্জে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত কাছারিবাড়িতে হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চায় ভারত

বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরে অবস্থিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত কাছারি বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ঘটনাকে ‘জঘন্য’ বলে উল্লেখ করে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। মন্ত্রণালয় বলেছে, এই ধরনের হামলা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দর্শনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটে, সে জন্য বাংলাদেশ সরকারের উচিত কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “এই হামলা অত্যন্ত দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। এর পেছনে যেসব উগ্রপন্থী জড়িত, তারা বাংলাদেশের সহনশীল ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নস্যাৎ করতে চায়।” তিনি আরও বলেন, “এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটে চলেছে, যা গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।”
রণধীর জয়সোয়াল বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যের নয়, উপমহাদেশের এক বিস্ময়কর সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব যাঁর শিক্ষা, ভাবনা ও দর্শন বিশ্বময় প্রশংসিত। “এই আক্রমণ গুরুদেবের দর্শনের পরিপন্থী। তাঁর অন্তর্ভুক্তিমূলক চিন্তাধারা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বার্তার বিপরীত।” জয়সোয়াল বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, যাতে তারা এই আক্রমণের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে।
ভাঙচুরের ঘটনার পটভূমি
গত সপ্তাহে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐতিহাসিক কাছারি বাড়িতে একদল দুর্বৃত্ত হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ওই সময় কাছারি বাড়ির স্থাপনা, দরজা-জানালা এবং মূল্যবান সংগ্রহশালার কিছু অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হামলার ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে হামলার প্রকৃত কারণ ও এর পেছনের ব্যক্তিদের এখনো নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা যায়নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কাছারি বাড়িতে বসেই “বৌঠাকুরাণীর হাট”, “চোখের বালি”সহ বহু বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম রচনা করেন। এই স্থানটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা উপমহাদেশে সাহিত্য ও সংস্কৃতির স্মারক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটক ও গবেষক এখানে আসেন রবীন্দ্রচর্চা ও সাহিত্য অনুধাবনের উদ্দেশ্যে।
ভারতের উদ্বেগ ও কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই ঘটনার নিন্দা জানানো কেবল সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রক্ষার প্রশ্ন নয়, বরং এটি দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ব্রিফিংয়ে জয়সোয়াল বলেন, “উগ্রপন্থীরা পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের সহনশীলতা ও সমন্বয়মূলক সংস্কৃতির প্রতীকগুলো ধ্বংসের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই হামলা সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ।” তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, “সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।”
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ও লন্ডন সফর প্রসঙ্গ
ব্রিফিংয়ের আরেক অংশে আলোচনায় আসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের একটি মন্তব্য। তিনি গতকাল লন্ডনে এক আলোচনায় বলেন, অতীতে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান এবং তাঁর সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন বক্তব্যে ভারত সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন ছিল। ইউনূস বলেন, তিনি নরেন্দ্র মোদিকে অনুরোধ করেছিলেন শেখ হাসিনার বক্তব্যে রাশ টানার ব্যবস্থা নিতে। জবাবে মোদি নাকি বলেছিলেন, ভারত সরকার সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রণধীর জয়সোয়াল বলেন, “ভারত কেমন সম্পর্ক চায়, সেটি আমরা বারবার বলেছি। আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক, গঠনমূলক ও জনগণের আকাঙ্ক্ষানুরূপ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই।” তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট, ভারত এই মুহূর্তে সম্পর্ক উন্নয়নের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে এবং রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকার নীতিতেই অটল থাকতে চায়।
সজীব ওয়াজেদ জয়ের দিল্লি সফর
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এক দিনের জন্য দিল্লি সফরে গিয়েছিলেন এবং তাঁর মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জয়সোয়াল বলেন, “আমি এই বিষয়ে কিছু জানি না। সংবাদটি সত্য কি না, তাও আমার জানা নেই।”
উপসংহার
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারি বাড়িতে হামলার ঘটনায় ভারতীয় প্রতিক্রিয়া স্পষ্টভাবে কূটনৈতিক বার্তা বহন করে। এটি শুধু একটি স্থাপনার ওপর হামলা নয়, বরং দুই দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও পারস্পরিক সম্পর্কের উপরও আঘাত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুই দেশেরই সম্মিলিত গর্ব। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই একমাত্র উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া হতে পারে।