কালুরঘাট সেতুতে ট্রেনের ধাক্কায় অটোরিকশা দুমড়ে-মুচড়ে, নিহত ২

চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতুতে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন দুইজন এবং আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন। ৫ জুন বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সেতুর বোয়ালখালী প্রান্তে কক্সবাজারগামী পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা দুমড়ে-মুচড়ে গেলে এই দুর্ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, স্থানীয় প্রশাসনের তথ্য এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) সূত্র অনুযায়ী প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে গঠিত হয়েছে এই প্রতিবেদন।
দুর্ঘটনার বিবরণ
রাত সাড়ে ১০টার দিকে কালুরঘাট রেলসেতু পার হচ্ছিল পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনটি। সে সময় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা সিগন্যাল অমান্য করে রেলসেতুর ওপর উঠলে, ট্রেনটি সেটিকে সজোরে ধাক্কা দেয়। ধাক্কার মাত্রায় অটোরিকশাটি দুমড়ে-মুচড়ে যায় এবং ঘটনাস্থলেই একজন নিহত হন।
প্রথমে নিহত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা না গেলেও পরে জানা যায়, তিনি অটোরিকশার চালক তুষার। দুর্ঘটনার পর অটোরিকশায় থাকা আরও যাত্রীরা গুরুতর আহত হন। দ্রুত স্থানীয়রা এবং ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করেন।
আহত ও নিহতদের পরিচয়
দুর্ঘটনায় নিহতদের একজন অটোরিকশাচালক তুষার। অপর নিহত ব্যক্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি তবে হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
আহতদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া গেছে, তারা হলেন—আসিফ উদ্দিন বাপ্পি, আসমা আহমেদ এবং আঞ্জু আরা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর তাদের অবস্থাকে আশঙ্কাজনক হিসেবে বর্ণনা করেছেন কর্তব্যরত চিকিৎসকরা। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, আরও দুইজনকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছে।
হৃদয়বিদারক দৃশ্য
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার পরের মুহূর্তগুলো ছিল অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, এক যুবক কান্নাজড়িত কণ্ঠে “আল্লাহু আকবর” বলতে বলতে কাঁধে একটি রক্তাক্ত শিশুকে বহন করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, শিশুটি তার সন্তান এবং সম্ভবত এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে।
তবে শিশুটির এবং যুবকের পরিচয় এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত করা যায়নি। ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক শোক ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
উদ্ধার কার্যক্রম ও প্রশাসনের ভূমিকা
কালুরঘাট ফায়ার স্টেশনের ফায়ার ফাইটার আমিনুল ইসলাম জানান, দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাত পৌনে ১১টার দিকে দুটি ইউনিট এবং একটি অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। দ্রুত উদ্ধার কাজ শুরু করা হয় এবং আহতদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। উদ্ধার কার্যক্রম গভীর রাত পর্যন্ত চলমান ছিল।
চমেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) আলাউদ্দিন তালুকদার বলেন, “আমরা আহত পাঁচজনকে হাসপাতালে ভর্তি করেছি। বাকিদের অবস্থান এবং পরিচয় নিশ্চিত করতে কাজ করছি।” তিনি আরও জানান, এ ধরণের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।
জনমনে আতঙ্ক ও ক্ষোভ
এই দুর্ঘটনার পর থেকে স্থানীয় জনগণের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। সেতুর দুই প্রান্তে প্রচুর মানুষ ভিড় করেন এবং দুর্ঘটনাস্থলে যান চলাচল ব্যাহত হয়। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, কিভাবে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা রেলসেতুর ওপর উঠতে পারল? যেখানে রেললাইনের ওপর দিয়ে যান চলাচল নিষিদ্ধ।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই কালুরঘাট সেতুতে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের নজরদারি দুর্বল। নিরাপত্তা রক্ষীদের অনুপস্থিতি, সিগন্যাল অমান্য করার প্রবণতা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে বারবার এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি
কালুরঘাট সেতু একাধারে রেল ও সড়ক সেতু হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে এর অবকাঠামো দীর্ঘদিন ধরেই জরাজীর্ণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিভিন্ন ঝুঁকির মুখে। বিশেষজ্ঞরা বহুবার বলেছেন, এখানে আধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা স্থাপন, গাড়ি ও ট্রেন চলাচলের সময়ভাগ আলাদা করা, এবং মানুষ ও যানবাহনের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
নিরাপত্তা ঘাটতির কারণে সেতুটিকে ‘দুর্ঘটনার ফাঁদ’ বলেও অভিহিত করেছেন অনেকে। স্থানীয় নাগরিকদের মতে, একটি আধুনিক রেলসেতু নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত এমন মর্মান্তিক ঘটনা থামবে না।
প্রশাসনের বক্তব্য
এ বিষয়ে রেলওয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, “ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, অটোরিকশা চালক সিগন্যাল অমান্য করেছেন। তবে আমাদের পক্ষ থেকেও নজরদারির ঘাটতি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ, রেল ক্রসিংয়ে স্বয়ংক্রিয় গেট স্থাপন এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রয়োজন অবিলম্বে পদক্ষেপ
এই দুর্ঘটনা আবারও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল—দেশের রেল ও সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কতটা ঘাটতি রয়েছে। জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত সময়ের মধ্যে সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ, সিগন্যাল ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা চালু করা একান্ত প্রয়োজন।
এছাড়া, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, নিয়ম না মানার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সক্রিয়তা বাড়াতে হবে।
উপসংহার
কালুরঘাট সেতুতে ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনা শুধু দুটি প্রাণ কেড়ে নেয়নি, বরং আবারও একটি বার্তা দিয়ে গেছে—নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত না হলে ভবিষ্যতে আরও প্রাণহানির আশঙ্কা থেকে যাবে। একযোগে প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ও সাধারণ জনগণকে সচেতন হয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে এমন দুর্ঘটনা আর না ঘটে।