আঞ্চলিক

চাঁদপুরের ৪০ গ্রামে ঈদ কাল

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী সাদ্রা দরবার শরীফের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে মিল রেখে আগামীকাল শুক্রবার (৬ জুন) চাঁদপুর জেলার ৪টি উপজেলার প্রায় ৪০টি গ্রামে ঈদুল আজহা উদযাপন করা হবে। বৃহস্পতিবার (৫ জুন) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সাদ্রা দরবার শরীফের পীর মাওলানা যাকারিয়া আল মাদানী।

তিনি জানান, “সৌদি আরব ও ইসলামের মূল উৎসভূমি হিসেবে বিবেচিত আরব দেশগুলোর চাঁদ দেখার ওপর ভিত্তি করেই আমরা রোজা, ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার তারিখ নির্ধারণ করে থাকি। কোরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে এই সিদ্ধান্ত দীর্ঘদিন ধরে পালিত হয়ে আসছে। আগাম রোজা ও ঈদ উদযাপন নতুন কিছু নয়, এটি একটি ধারাবাহিক ধর্মীয় অনুশীলন।”

ঈদের প্রধান জামাত সকাল ৮টায়

পীর যাকারিয়া আল মাদানী জানান, আগামীকাল শুক্রবার সকাল ৮টায় সাদ্রা দরবার শরীফ প্রাঙ্গণে ঈদুল আজহার প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে তিনি নিজেই ইমামতি করবেন। দরবার শরীফে ইতোমধ্যেই ঈদের জামাত সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।

সাদ্রা দরবার শরীফের অনুসারীরা মনে করেন, ঈদুল আজহার মূল তাৎপর্য হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর কোরবানি এবং ত্যাগের আদর্শ। তাই ঈদুল আজহা পালনে দিন গণনার ক্ষেত্রে সহীহ চাঁদ দেখাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

যে সব গ্রামে আগাম ঈদ পালিত হবে

চাঁদপুরের চারটি উপজেলার অন্তত ৪০টি গ্রামে সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে আগাম ঈদ উদযাপন করা হবে। এ গ্রামগুলোর মধ্যে হাজীগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ, মতলব ও কচুয়া উপজেলার অনেক এলাকাই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

হাজীগঞ্জ উপজেলার সাদ্রা, সমেশপুর, অলিপুর, বলাখাল, মনিহার, প্রতাপপুর, বাসারা গ্রামগুলোর মুসল্লিরা আগাম ঈদে অংশ নেবেন।

ফরিদগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপুর, কামতা, গল্লাক, ভুলাচোঁ, সোনাচোঁ, উভারামপুর, উটতলি, মুন্সিরহাট, কাইতাড়া, মূলপাড়া, বদরপুর, আইটপাড়া, সুরঙ্গচাইল, বালিথুবা, পাইকপাড়া, নূরপুর, সাচনমেঘ, শোল্লা, হাঁসা, গোবিন্দপুর—এইসব এলাকাগুলোতেও ঈদ উদযাপনের জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।

মতলব উপজেলার দশানী, মোহনপুর, পাঁচানী এবং কচুয়া ও শাহরাস্তি উপজেলার কয়েকটি গ্রামেও আগাম ঈদের প্রস্তুতি চলছে।

ঐতিহাসিক পটভূমি: সাদ্রা দরবারের নেতৃত্বে আগাম রোজা-ঈদ পালন

সাদ্রা দরবার শরীফের পক্ষ থেকে জানা যায়, এই আগাম রোজা ও ঈদ পালন প্রথার সূচনা করেন মাওলানা ইসহাক (রহ.)। ১৯২৮ সাল থেকে তিনি সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে রোজা, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা পালন শুরু করেন। এই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেই তার অনুসারীরা প্রায় এক শতাব্দী ধরে একইভাবে ঈদ উদযাপন করে আসছেন।

এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, বরং একটি আত্মিক সংযোগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও বিবেচিত হয়। সাদ্রা দরবারের অনুসারীদের মতে, ইসলামের মূল চর্চা কেন্দ্রগুলোতে যেভাবে ধর্মীয় উৎসব পালিত হয়, তার সঙ্গে মিল রেখে চলাই উত্তম।

স্থানীয় প্রতিক্রিয়া ও সামাজিক প্রভাব

চাঁদপুর জেলার বিভিন্ন গ্রামে ঈদ উদযাপনের ভিন্নতার কারণে উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। তবে স্থানীয় মুসল্লিরা বিষয়টিকে ধর্মীয় মতপার্থক্যের জায়গা থেকে না দেখে বরং বিশ্বাস ও চর্চার ভিন্ন রূপ হিসেবে মেনে নেন।

স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও ঈদের জামাত নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার জন্য নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাজীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। তিনি বলেন, “সাদ্রা দরবার শরীফ একটি ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। তাই ঈদের জামাত ঘিরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।”

বিশেষ বার্তা: ধর্মীয় সহনশীলতা ও ঐক্যের আহ্বান

ধর্মীয় মতভেদ থাকা স্বাভাবিক এবং ইসলাম এ বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। ঈদুল আজহা একটি ত্যাগ ও সহনশীলতার উৎসব, যেখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং ঐক্যই সর্বোচ্চ প্রাধান্য পাওয়া উচিত।

সাদ্রা দরবার শরীফের পীর যাকারিয়া আল মাদানী সকল মুসলমানদের উদ্দেশ্যে এক বার্তায় বলেন, “আমরা মুসলমান, আমাদের লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি। চাঁদ দেখার পদ্ধতি কিংবা ঈদের তারিখে ভিন্নতা থাকলেও আমাদের হৃদয় যেন ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। আমাদের দোয়া, কোরবানি ও ইবাদত যেন মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও কল্যাণ বয়ে আনে।”

উপসংহার

চাঁদপুরে আগাম ঈদ উদযাপন একটি দীর্ঘদিনের ধর্মীয় ঐতিহ্য যা স্থানীয়ভাবে গৃহীত এবং শ্রদ্ধেয়। পীর ইসহাক (রহ.)-এর রেখে যাওয়া চর্চার ধারাবাহিকতা আজো অনুসরণ করা হচ্ছে দরবার শরীফের অনুসারীদের দ্বারা। তাদের এই উৎসব পালন কেবল ধর্মীয় অনুশীলন নয়, বরং ঐতিহাসিক চেতনাবোধ এবং আত্মিক সংযোগের বহিঃপ্রকাশ।

এদিকে, দেশের অন্যান্য অংশে সরকার নির্ধারিত ঈদের তারিখ অনুযায়ী ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে শনিবার (৭ জুন)।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button