বিছনাকান্দিতে পাথর চুরি ঠেকাতে বিএসএফের সাউন্ড গ্রেনেড ও ফাঁকা গুলি

সিলেটের বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র বিছনাকান্দিতে পাথর চুরি ঠেকাতে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। বুধবার (৪ জুন) রাত ১১টার দিকে সীমান্ত পেরিয়ে পাথর তুলতে যাওয়া কিছু শ্রমিকের ওপর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে এবং একটি ফাঁকা গুলি চালায়। এই ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
কী ঘটেছিল বিছনাকান্দিতে?
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার বিছনাকান্দি এলাকা দীর্ঘদিন ধরে পাথরখেকোদের (অবৈধ পাথর উত্তোলনকারী) লক্ষ্যবস্তু। এলাকাটি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী হওয়ায়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এটি অস্থির হয়ে উঠেছে চোরাচালান ও অবৈধ পাথর উত্তোলনের কারণে।
স্থানীয় সূত্র ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানায়, বুধবার রাতে কয়েকজন শ্রমিক নৌকা নিয়ে সীমান্ত সংলগ্ন শূন্যরেখার দিকে এগিয়ে যান এবং ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে পাথর উত্তোলন শুরু করেন। বিষয়টি বুঝতে পেরে বিজিবি সদস্যরা বাঁশি বাজিয়ে শ্রমিকদের সতর্ক করে দেন এবং তাঁদের এলাকা ত্যাগে বাধ্য করেন। এরই মধ্যে বিএসএফ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে শ্রমিকদের লক্ষ্য করে দুটি সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে ও একটি ফাঁকা গুলি চালায়।
বিজিবির অবস্থান
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিলেট ব্যাটালিয়ন ৪৮ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ নাজমুল হক। তিনি বলেন,
“শ্রমিকেরা শূন্যরেখা অতিক্রম করে ভারতের সীমান্তে চলে গিয়েছিল। আমরা বাঁশি বাজিয়ে তাদের সতর্ক করে তাড়িয়ে দিই। এ সময় বিএসএফ সম্ভবত ভয় দেখানোর জন্য দুটি সাউন্ড গ্রেনেড এবং একটি ফাঁকা গুলি ছোড়ে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এবং সীমান্তে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে।”
বিএসএফ কেন গুলি চালায়?
সীমান্ত এলাকায় চোরাকারবার ও পাথর চুরি ঠেকাতে বিএসএফ অতীতে একাধিকবার কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। বিছনাকান্দি সীমান্ত এলাকায় আগেও বিএসএফ গুলি চালিয়েছে, তবে সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহারের ঘটনা এবার বেশ চোখে পড়ার মতো। সাউন্ড গ্রেনেড সাধারণত শব্দ ও আলো ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে থাকে। এটি প্রাণঘাতী নয়, তবে আতঙ্ক সৃষ্টি করে জনতাকে এলাকা ত্যাগে বাধ্য করা হয়।
স্থানীয়দের আতঙ্ক
ঘটনার পর থেকেই বিছনাকান্দি এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে চরম উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। এক স্থানীয় বলেন,
“আমরা মাঝে মাঝেই দেখছি, কিছু মানুষ রাতের আঁধারে সীমান্ত পেরিয়ে পাথর তোলে। এখন তো গুলি-বোমা চলছে। এটা পর্যটনের জন্য ভয়ানক খারাপ খবর।”
আরেকজন জানান,
“বিছনাকান্দিতে এখন কেউ রাতের বেলা ঘোরাঘুরি করতে সাহস করছে না। সীমান্তের ভেতরেই যদি এমন গোলমাল চলে, তাহলে তো কোনোদিন বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।”
পর্যটনে প্রভাব পড়বে?
বিছনাকান্দি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন। এমন একটি জায়গায় রাতে গোলাগুলির খবর পর্যটকদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
পর্যটন ব্যবসায়ী সমিতির এক সদস্য বলেন,
“ইতিমধ্যে হোটেল বুকিং কমে গেছে। যদি এমন ঘটনা আরও ঘটে, তাহলে পুরো পর্যটন ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়বে।”
সীমান্ত নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ করণীয়
বিছনাকান্দি সীমান্তে অবৈধ প্রবেশ, পাথর চুরি, চোরাচালান এবং বিএসএফ-বিজিবির মুখোমুখি অবস্থান আগেও হয়েছে। তবে এবারের ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে— কেন শ্রমিকরা শূন্যরেখা পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পাথর তুলতে গেল? আর সীমান্ত নজরদারিতে ত্রুটি ছিল কি না?
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে দরকার কড়া নজরদারি, সচেতনতা এবং আন্তঃদেশীয় সমন্বয়। সীমান্তবর্তী শ্রমজীবীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি, যাতে তারা সীমান্ত আইন লঙ্ঘন না করে।
বিজিবি ও বিএসএফের যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন
এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে বিজিবি ও বিএসএফের যৌথ টহল এবং নিয়মিত সংলাপের ওপর জোর দিয়েছেন সীমান্ত বিশ্লেষকরা। অতীতে বিজিবি-বিএসএফের মধ্যে ফ্ল্যাগ মিটিং বা যৌথ পেট্রোলিংয়ের মতো উদ্যোগ দেখা গেছে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয় বলে মন্তব্য অনেকের।
পূর্বেও এমন ঘটনা ঘটেছে
উল্লেখ্য, বিছনাকান্দি সীমান্তে ২০২২ ও ২০২৩ সালে একাধিকবার পাথরচুরির অভিযোগে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি শ্রমিক আহত হয়েছেন। কখনো কখনো এসব ঘটনায় প্রাণহানিও ঘটেছে। যদিও এবার এমন কিছু ঘটেনি, তবে এ ধরনের আগ্রাসী প্রতিক্রিয়া প্রশ্ন তুলছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড নিয়েও।