
বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা নিয়ে চলমান জল্পনার অবসান ঘটালেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। তিনি জানিয়েছেন, ডিসেম্বরের প্রথমার্ধেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। আর আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট অনুষ্ঠিত হতে পারে।
শনিবার (১৮ অক্টোবর) বিকেলে বরিশাল সার্কিট হাউজ মিলনায়তনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ তথ্য জানান।
নির্বাচনের সময়সূচি চূড়ান্তের পথে
সিইসি বলেন, “আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা করা হবে।”
তিনি আরও জানান, নির্বাচনী প্রস্তুতি এখন শেষ পর্যায়ে, এবং কমিশন একটি স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।
বরিশাল বিভাগের কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, “আমরা চাই, এই নির্বাচন হবে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের একটি বড় সুযোগ। এজন্য প্রশাসনের সব স্তরে সমন্বয় জরুরি।”
আওয়ামী লীগ ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিয়ে মন্তব্য
প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাঁর বক্তব্যে বলেন, “বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। তবে বিচার সম্পন্ন হলে, সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
এ বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি ফেব্রুয়ারিতেই ভোট হয়, তবে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে রাজনৈতিক দলগুলো সক্রিয় প্রচারণায় নামবে।
প্রতীক বরাদ্দ ও এনসিপির দাবি প্রসঙ্গে সিইসি’র ব্যাখ্যা
মতবিনিময় সভায় এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, “নির্বাচন কমিশনের তালিকায় যাদের নাম নেই, তাদের প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব নয়।”
তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, এনসিপির ‘শাপলা’ প্রতীকের দাবি আইনত গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ দলটি কমিশনের নিবন্ধিত দলের তালিকায় নেই।
“আমরা আইনের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না,”— যোগ করেন তিনি।
কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সিইসি’র বক্তব্য
প্রধান নির্বাচন কমিশনার দৃঢ়ভাবে বলেন, “নির্বাচন কমিশন কোনো গোয়েন্দা সংস্থা বা কোনো রাজনৈতিক প্রভাবের অধীনে কাজ করবে না।”
তিনি সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেন, নির্বাচনকালীন সময়েও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বজায় থাকবে, এবং সংবাদ সংগ্রহে কোনো বাধা সৃষ্টি করা হবে না।
“স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনের জন্য গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম,”— বলেন তিনি।
প্রশাসনিক প্রস্তুতি ও মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম
সিইসি নাসির উদ্দিন জানান, সারাদেশে নির্বাচনকেন্দ্রের তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে এবং ভোটকেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ চলছে।
তিনি বলেন, “আমরা চাই, ভোটের দিন যেন ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন। এজন্য প্রতিটি জেলার প্রশাসনকে আগেভাগে পরিকল্পনা নিতে বলা হয়েছে।”
সভায় উপস্থিত ছিলেন বরিশাল বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার মো. রায়হান কাওছার, ছয় জেলার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, এবং নির্বাচন কর্মকর্তারা।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচনী উত্তাপ
তফসিল ঘোষণার সময় ঘনিয়ে আসায় রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ বাড়ছে। বিএনপি ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা “অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া কোনো প্রহসনে যাবে না।” অন্যদিকে কয়েকটি ছোট দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যদি ডিসেম্বরেই তফসিল ঘোষণা হয়, তবে নভেম্বরের মধ্যেই প্রার্থীদের মনোনয়ন ও যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে।
তারা মনে করছেন, এবার নির্বাচন কমিশন চায় আগের তুলনায় দ্রুত ও কার্যকর নির্বাচনী রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করতে।
ভোটার তালিকা ও প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা
নির্বাচন কমিশনের সূত্রে জানা গেছে, ভোটার তালিকা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। মোট ভোটারের সংখ্যা হবে প্রায় ১১ কোটি ২০ লাখ।
ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহারের বিষয়ে সিইসি বলেন, “যেসব এলাকায় ভোটকেন্দ্র প্রস্তুত এবং প্রশিক্ষিত জনবল রয়েছে, সেসব এলাকায় ইভিএম ব্যবহার করা হবে। অন্যত্র প্রচলিত ব্যালটেই ভোট নেওয়া হবে।”
তিনি আরও জানান, ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া আধুনিক করতে কমিশন সর্বোচ্চ প্রযুক্তিগত সহায়তা নিচ্ছে।
স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অঙ্গীকার
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, “জনগণ যেন নিজেদের প্রতিনিধি নিজেরাই বেছে নিতে পারেন, সেটাই আমাদের লক্ষ্য।”
তিনি যোগ করেন, “সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক — এটাই আমরা চাই। এজন্য আইনি ও প্রশাসনিক সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে।”
তফসিল ঘোষণার পরপরই মনোনয়নপত্র জমা, যাচাই-বাছাই ও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময়সূচি প্রকাশ করা হবে বলে জানান সিইসি।
নির্বাচনপূর্ব উত্তেজনা ও জনআকাঙ্ক্ষা
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রতীক্ষায় এখন পুরো দেশ। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই সেই ঘোষণার সম্ভাবনা থাকায় রাজনীতির মাঠে উষ্ণতা বাড়ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এবার নির্বাচন কমিশনের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিরপেক্ষতা, অংশগ্রহণ ও নিরাপত্তা—এই তিনটি বিষয় একসঙ্গে বজায় রাখা।
জনগণের প্রত্যাশা, একটি স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক — যেখানে প্রতিটি ভোটের মূল্য রক্ষা পাবে।
এম আর এম – ১৮৩৮,Signalbd.com