জাতীয়

পুলিশের হাতে আর থাকবে না মারণাস্ত্র: আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে বড় সিদ্ধান্ত

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও জনবান্ধব রাখতে বড় ধরনের নীতিগত পরিবর্তনের পথে হাঁটছে সরকার। পুলিশের হাতে থাকা সব ধরনের মারণাস্ত্র তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সোমবার (১২ মে) অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এ সিদ্ধান্তের কথা গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন। পাশাপাশি র‍্যাব পুনর্গঠন, ঈদ ঘিরে চাঁদাবাজি প্রতিরোধ, শ্রমিকদের বেতন ইস্যু ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের মাধ্যমে অনুপ্রবেশ নিয়ে বক্তব্য দেন তিনি।

মারণাস্ত্র আর নয় পুলিশের হাতে

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “পুলিশের হাতে কোনো মারণাস্ত্র থাকবে না। যাদের কাছে এখনও মারণাস্ত্র রয়েছে, সেগুলোও ফিরিয়ে নিতে হবে।”

এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর কৌশলগত ব্যবস্থাপনায় একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণ জনগণের মধ্যে পুলিশের বিরুদ্ধে ‘ভয়’ বা ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের’ যে অভিযোগ আছে, তা দূর করতেই এমন সিদ্ধান্ত।

কেন এই সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ?

বর্তমানে পুলিশ বাহিনীর কাছে রয়েছে পিস্তল, রাইফেল, শটগানসহ বিভিন্ন ধরনের মারণাস্ত্র। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে বহু সময়েই গণপিটুনি, রাজনৈতিক দমন, কিংবা অপারেশন চলাকালীন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল—সাধারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা বাহিনীর হাতে যেন কেবলমাত্র আত্মরক্ষামূলক বা নিয়ন্ত্রণমূলক অস্ত্র (যেমন—রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস, স্টান গান) থাকে। সরকার অবশেষে সে পথেই হাটতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

র‍্যাব পুনর্গঠন হচ্ছে, গঠন করা হয়েছে কমিটি

বৈঠকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) পুনর্গঠন নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। এ বিষয়ে তিনি বলেন, “র‍্যাব পুনর্গঠন নিয়ে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে।”

র‍্যাব প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বিভিন্ন সাফল্যের পাশাপাশি কিছু বিতর্কেও জড়িয়েছে। বিশেষ করে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর অভিযোগে বাহিনীটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নজরেও এসেছে। পুনর্গঠনের এই উদ্যোগকে অনেকে স্বাগত জানালেও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার দিকে নজর থাকবে সবার।

ঈদ সামনে রেখে বিশেষ সতর্কতা

ঈদকে কেন্দ্র করে শহরজুড়ে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ও অপরাধ প্রবণতা বাড়তে পারে—এমন আশঙ্কা থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিশেষভাবে তৎপর থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “ঈদ সামনে রেখে চাঁদাবাজি ও ছিনতাইরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর আছে।”

পাশাপাশি তিনি গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন ও বোনাস সময়মতো পরিশোধের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। তার ভাষায়, “ঈদের আগেই শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ নিশ্চিত করতে হবে।”

বলা বাহুল্য, প্রতিবছর ঈদের আগে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয় বেতন পরিশোধ না হলে। এ কারণে আগেভাগেই সতর্ক হতে বলেছে সরকার।

পুশ-ইন নিয়ে উদ্বেগ

ব্রিফিংয়ে আলোচনায় আসে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ‘পুশ-ইন’ হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়টি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “সীমান্তে যাদের পুশ-ইন করা হচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশি।”

পুশ-ইন বলতে বোঝায়—বিদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিকদের জোর করে সীমান্ত অতিক্রম করিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া।

বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যেই দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে একাধিকবার পতাকা বৈঠক হলেও সমস্যা থেকে যাচ্ছে। নতুন করে আবার এ বিষয়ে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে বলেই ধারণা করা যাচ্ছে।

মারণাস্ত্রহীন পুলিশ: কী হতে পারে প্রভাব?

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ঘোষণার পর প্রশ্ন উঠেছে—মারণাস্ত্র ছাড়া কীভাবে পুলিশ কার্যকরভাবে কাজ করবে?

সংশ্লিষ্টদের মতে, বিশ্বজুড়ে অনেক দেশেই নাগরিক পুলিশের হাতে মারাত্মক অস্ত্র থাকে না। প্রয়োজন হলে বিশেষ বাহিনী সহায়তা করে। বাংলাদেশেও সেই পথে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।

এই সিদ্ধান্তের ফলে—

  • পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব কমবে।
  • অহেতুক গুলি চালানো বা প্রাণহানির সম্ভাবনা কমবে।
  • পুলিশ বাহিনীকে জনবান্ধব বাহিনীতে রূপান্তরের পথে এটি একটি বড় পদক্ষেপ হবে।

তবে এ ধরনের পরিবর্তন বাস্তবায়নে প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, সচেতনতা এবং প্রযুক্তির উন্নত ব্যবহার।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশে সক্রিয় বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক বিবৃতিতে বলেছে, “এটি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। আমরা চাই, এটি বাস্তবায়নে যেন আন্তরিকতা ও ধারাবাহিকতা থাকে।”

তবে তারা আরও বলছে, শুধু অস্ত্র প্রত্যাহার করলেই হবে না, বরং পুলিশ বাহিনীর মধ্যে মানবাধিকার, আচরণগত শুদ্ধাচার, ও জনসেবামূলক মনোভাব গড়ার জন্যও ব্যাপক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button