জাতীয়

পিলখানা হত্যাকাণ্ড: বিস্ফোরক মামলায় আরও ৪০ বিডিআর সদস্য জামিনে মুক্ত

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া অন্যতম ভয়াবহ এবং হৃদয়বিদারক ঘটনা পিলখানা হত্যাকাণ্ডে বিস্ফোরক মামলায় দ্বিতীয় দফায় জামিন পেয়েছেন বিডিআরের আরও ৪০ জন সদস্য। দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর পর মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে পৌঁছেছে এই রায়।

আদালতের রায় ও জামিনপ্রাপ্ত সদস্যদের তালিকা

সর্বশেষ ৮ মে (২০২৫) ঢাকার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক ইব্রাহিম মিয়ার আদালত ৪০ জন আসামিকে জামিন প্রদান করেন। এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বেঞ্চ সহকারী শাহাদাৎ হোসেন।

এর আগে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি একই মামলায় ১৭৮ জন বিডিআর সদস্য জামিন পেয়েছিলেন এবং ২৩ জানুয়ারি তারা কাশিমপুর ও কেরানীগঞ্জ কারাগার থেকে মুক্তি পান। এবার দ্বিতীয় দফায় জামিনপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন:

রেজাউল করিম, শাজাহান, রফিকুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, মো. শামীম, ওয়ালি উল্লাহ, হাবিবুর রহমান, তারিকুল ইসলাম, বনি আমিন চৌধুরী, মো. এ বারিক, ইমতিয়াজ আহমেদ নবীন, মোয়াজ্জেম হোসেন, মিজানুর রহমান, সিদ্দিকুর জামান জোয়ার্দার (লিটন), মো. এ মোনাফ, আকিদুল ইসলাম, খলিলুর রহমান, কৌতুক কুমার সরকার, মো. সালাউদ্দিন, সোহরাব হোসেন, কামাল হোসেন, মো. ইশহাক, দারুল ইসলাম, শ্রী সুমন চক্রবর্তী, আবু সাঈদ, সেজান মাহমুদ, মো. সেলিম, বিধান কুমার সাহা, মাসুম হাসান, ফিরোজ মিয়া, শ্রী তাপস কুমার বিশ্বাস, রফিকুল ইসলাম, কামাল মিয়া, নূর-এ-আলম মিয়া, এনামুল হক, শফিকুল ইসলাম, রবিউল আলম এবং আল আমিন।

পিলখানা হত্যাকাণ্ড: পটভূমি ও বিচারিক প্রক্রিয়া

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানায় বিদ্রোহ শুরু হয়। এই বিদ্রোহ চলাকালীন সময় বিডিআর সদস্যরা সেনাবাহিনী থেকে আগত তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। দুই দিনের সেই বিভীষিকাময় ঘটনায় শহীদ হন ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা, যাদের অনেকেই তাদের পরিবারের সদস্যসহ সেখানে অবস্থান করছিলেন। নিহত হন আরও ১৭ জন অসামরিক ব্যক্তি। মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৪ জনে।

এই ঘটনার পর দুটি মামলা দায়ের হয়—একটি হত্যা মামলা এবং অপরটি বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে।

বিস্ফোরক মামলার অগ্রগতি ও রায়

২০১০ সালে বিস্ফোরক মামলায় ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্ট থেকে রায় দেওয়া হয়, যেখানে:

  • ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়,
  • ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করা হয়,
  • ২২৮ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়,
  • এবং খালাস পান ২৮৩ জন

হত্যা মামলার অগ্রগতি ও আপিল

২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর নিম্ন আদালত বিডিআর হত্যা মামলার রায় দেয়। এতে:

  • ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড,
  • ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন এবং
  • ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।

খালাস পেয়েছিলেন ২৭৮ জন। এরপর হাইকোর্টে আপিলের প্রক্রিয়া শুরু হয়। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ২২৬ জন আসামি আপিল ও লিভ টু আপিল করেন এবং রাষ্ট্রপক্ষ ৮৩ জন আসামির খালাস ও সাজা হ্রাসের বিরুদ্ধে আপিল করে

তদন্ত পুনরায় শুরুর সিদ্ধান্ত

২০২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর, অন্তর্বর্তী সরকার এই ভয়াবহ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত পুনরায় শুরু করার ঘোষণা দেয়। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমানকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করা হয় এবং কমিশনকে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে অনেকেই আশা করছেন, অবশেষে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের অজানা দিকগুলো জনগণের সামনে স্পষ্ট হবে।

জামিন ও বিচার: মানবাধিকার ও বিচারপ্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জ

অনেক আসামি দাবি করেছেন, তারা কেবল বিডিআরের সাধারণ সদস্য ছিলেন এবং এই ঘটনায় তারা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেননি। এমনকি অনেকে তাদের নির্দোষ প্রমাণে দীর্ঘদিন ধরে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। দীর্ঘ কারাভোগ ও প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে জামিনপ্রাপ্তদের পরিবারে দেখা দিয়েছে স্বস্তি ও আশার আলো।

আইনজীবীরা বলছেন, বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা, স্বাক্ষীর অনুপস্থিতি এবং পর্যাপ্ত প্রমাণ না থাকায় অনেকেই জামিন পাচ্ছেন। তবে সরকার এবং রাষ্ট্রপক্ষ মামলাকে গুরুত্ব দিয়ে সব ধাপ অনুসরণ করে রায় কার্যকর করার আশ্বাস দিয়েছে।

সমাপ্তি কথা

বিডিআর হত্যাকাণ্ড ও বিস্ফোরক মামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গভীর ক্ষত। একদিকে যেমন সেনা কর্মকর্তাদের নির্মম হত্যাকাণ্ড, অন্যদিকে বহু সাধারণ বিডিআর সদস্য বছরের পর বছর কারাগারে বন্দী। বর্তমানে নতুন করে জামিন পাওয়া সদস্যদের মুক্তি এই দীর্ঘযাত্রার একটি ধাপ হলেও, পুরোপুরি বিচার ও সত্য উদ্ঘাটনের অপেক্ষায় দেশবাসী।

সরকারের নতুন তদন্ত কমিশন যদি সত্য ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে পারে, তবে এ ঘটনা থেকে ভবিষ্যতের জন্য মূল্যবান শিক্ষা নেওয়া সম্ভব হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button