হাজার কোটি টাকা লোপাট অভিযোগে শেখ হাসিনাকে ৮ মে তলব করলো দুদক।

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে আগামী ৮ মে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে এই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকার ধানমন্ডির সুধাসদনের ঠিকানায় সরকারি চিঠি পাঠানো হয়েছে, যা দুদকের উপপরিচালক মনিরুল ইসলাম স্বাক্ষর করেছেন।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, এটি কেবল নিয়মিত তলব নয়, বরং একটি জরুরি ও গুরুতর পর্যায়ের তদন্তের অংশ হিসেবে করা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে এই মামলাটি হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ দুর্নীতির মামলা।
তলবের পেছনের কারণ: বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে লোপাটের অভিযোগ
দুদকের মতে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চারটি উন্নয়ন প্রকল্পে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো:
- হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল
- চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল উন্নয়ন
- সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্প
এই চার প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা। অথচ প্রকল্প বাস্তবায়নে বহু অনিয়ম, অদৃশ্য ব্যয় এবং ‘গোপন চুক্তি’ সহ নানা আর্থিক দুর্ব্যবস্থার অভিযোগ উঠে।
দুদকের আগের মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দুদক এই প্রকল্পগুলোর আর্থিক তদন্ত শুরু করে। পরে ৯০০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করে, যাতে ১৯ জনকে আসামি করা হয়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন:
- শেখ হাসিনার সাবেক সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকী
- সাবেক বিমান সচিব মুহিবুল হক
- বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সাবেক চেয়ারম্যান এম মুফিদুর রহমান
এই মামলায় শেখ হাসিনার নাম সরাসরি আসামি তালিকায় না থাকলেও তদন্তে তার ‘নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত’ নেওয়ার প্রমাণ পাওয়ায়, এবার তাকে প্রাথমিক আসামির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে এবং তলবে সাড়া না দিলে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ হারাবেন বলেও জানিয়েছেন দুদকের একাধিক কর্মকর্তা।
ভারতে অবস্থান ও রাজনৈতিক পটভূমি
২০২৪ সালের শেষে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নির্বাচনী বিতর্কের প্রেক্ষাপটে ভারতে অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও তাৎক্ষণিকভাবে তিনি বলেছেন, এটি ‘ব্যক্তিগত সফর’, তবে এরপর আর তিনি দেশে ফিরে আসেননি।
বর্তমানে ভারত সরকারের বিশেষ প্রটোকলে তিনি অবস্থান করছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সম্পর্ক তেমন উষ্ণ নয়। ফলে ভারতের পক্ষ থেকে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে কি না, তা নিয়ে কূটনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে।
দুর্নীতি নিয়ে বিরোধী পক্ষের প্রতিক্রিয়া
বর্তমান সরকার এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেই দুদকের এই পদক্ষেপকে অনেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে করলেও, দুদক দাবি করছে—তারা শুধুমাত্র প্রাপ্ত তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে তদন্ত চালাচ্ছে।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, “এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে দেশে জবাবদিহিতার ব্যবস্থা সচল হয়েছে। এতদিন যারা untouchable ছিল, তারাও এখন আইনের আওতায় আসছে।”
অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “দুই দশক ধরে শেখ হাসিনা যেভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় ও আত্মসাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। আমরা দুদকের পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই।”
বিশ্লেষণ: রাজনীতি, আইনি ব্যবস্থা এবং প্রভাব
বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনার এই তলব শুধুমাত্র আইনি পদক্ষেপ নয়, বরং এটি দেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে একটি বড় মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। তিনি তলবে সাড়া দিলে, তা বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা আনবে। আর সাড়া না দিলে, তার বিরুদ্ধে প্রতারণা ও আইনি দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগে আরও মামলা হতে পারে।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিশ্লেষক ও আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজিম আহমেদ বলেন, “শেখ হাসিনা যদি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন, তাহলে তার উচিত হবে দেশে ফিরে তদন্তে অংশগ্রহণ করা। নইলে এটা দেশের আইনি ব্যবস্থার প্রতি অসম্মান হবে।”
দুদকের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ কী হতে পারে?
১. শেখ হাসিনা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজির না হলে, তার বিরুদ্ধে আদালতে ‘বিচারবহির্ভূত গ্রেফতারি পরোয়ানা’ জারি হতে পারে।
২. ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হতে পারে।
৩. ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে তাকে ফেরত আনার কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে।
৪. প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম জোরদার হবে।