বিআরটিএর ৩৫টি কার্যালয়ে দুদকের একযোগে অভিযান

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সেবা খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলা ঘুষ-দালাল চক্রের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবার কড়া অবস্থান নিয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির ফিটনেস সনদ গ্রহণে ঘুষ লেনদেন, অবৈধ দালাল চক্রের প্রভাব এবং সেবাপ্রাপ্তিতে হয়রানির অভিযোগের ভিত্তিতে বুধবার সকালে দেশের একযোগে ৩৫টি বিআরটিএ কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছে দুদক।
সকালেই শুরু হয় অভিযান, চলছে অব্যাহতভাবে
দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট সকাল থেকেই অভিযান শুরু করে এবং দুপুর পর্যন্ত তা চলমান ছিল। সূত্র জানায়, এই অভিযান এক দিনের মধ্যে শেষ হচ্ছে না—দুদকের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান ও প্রমাণ সংগ্রহ করে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
দুদকের উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, “ড্রাইভিং লাইসেন্স ও ফিটনেস সনদ দিতে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সাধারণ মানুষ দালাল চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এসব বন্ধে আমরা আজ ৩৫টি কার্যালয়ে একযোগে অভিযান পরিচালনা করছি।”
কোন কোন এলাকায় অভিযান চালানো হয়েছে?
এই অভিযানের আওতায় দেশের প্রায় সব বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ বিআরটিএ কার্যালয় রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে:
- ঢাকা বিভাগ: উত্তরা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার
- চট্টগ্রাম বিভাগ: কক্সবাজার, কুমিল্লা, রাঙামাটি
- খুলনা বিভাগ: যশোর, মেহেরপুর
- রাজশাহী বিভাগ: জয়পুরহাট
- বরিশাল বিভাগ: বরগুনা
- সিলেট বিভাগ: মৌলভীবাজার
- রংপুর বিভাগ: নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও
- ময়মনসিংহ বিভাগ: শেরপুর
অভিযান পরিচালনাকারী দলগুলো প্রত্যেক কার্যালয়ে উপস্থিত থেকে সরেজমিনে ঘুষ লেনদেন ও দালাল চক্রের কার্যক্রম পর্যালোচনা করছে। সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সংগ্রহ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে দুদক জানায়।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার ও দুদকের কঠোর অবস্থান
বর্তমান সরকার বারবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কথা বললেও বাস্তব চিত্রে বিআরটিএসহ অনেক সরকারি দপ্তরে সাধারণ মানুষ ঘুষ ছাড়া সেবা পান না বলে অভিযোগ রয়েছে। বিআরটিএ অফিসগুলোর বাইরে দালাল চক্রের প্রকাশ্য উপস্থিতি ও প্রভাব দীর্ঘদিন ধরেই সাধারণ নাগরিকদের হয়রানির অন্যতম কারণ।
বিআরটিএ-তে সেবা নিতে গিয়ে অনেক সময় ২০০ টাকা মূল্যের একটি ফিটনেস সনদের জন্য ২০০০ টাকাও দিতে হয় দালালের মাধ্যমে। একইভাবে লাইসেন্স পেতে শিক্ষানবিশ চালককে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত গচ্চা দিতে হয়। অথচ এই কাজগুলো সরকারি ফি পরিশোধ করেই সহজে সম্পন্ন হওয়ার কথা।
জনমনে স্বস্তি, তবে স্থায়ী সমাধান চান সচেতন নাগরিকরা
এই অভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সাধারণ মানুষ মনে করছেন, এ ধরনের অভিযান স্বস্তিদায়ক হলেও, এটি যেন নিয়মিত হয়। কেবলমাত্র এক দিনের অভিযান দিয়ে দীর্ঘদিনের দুর্নীতির শেকড় উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়।
ঢাকার উত্তরা বিআরটিএ অফিসে লাইসেন্স নিতে আসা একজন আবেদনকারী বলেন, “আজ অনেকটা স্বস্তিতে কাজ করেছি। কোনো দালাল চোখে পড়েনি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দুদক যদি প্রতিদিন না আসে, তাহলে কি আবার আগের মতো ঘুষ-দালাল রাজত্ব ফিরে আসবে?”
বিআরটিএর ভাবমূর্তি ফেরাতে সংস্কার জরুরি
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিআরটিএর ডিজিটালাইজেশন, সেবা কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, এবং কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানো না গেলে এ ধরনের অভিযানেও টেকসই ফল আসবে না। প্রয়োজন:
- সকল আবেদন ও ফি প্রদান প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অনলাইনে রূপান্তর
- অফিস চত্বর দালালমুক্ত রাখতে সিসিটিভি ও নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ
- ঘুষ লেনদেনের ঘটনায় তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা ও শাস্তি নিশ্চিত করা
- সেবা গ্রহীতাদের নিরাপদ অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা চালু
দুদকের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
দুদক সূত্র জানিয়েছে, বিআরটিএর পর ভবিষ্যতে আরও সরকারি সেবাখাতে এ ধরনের সমন্বিত অভিযান চালানো হবে। বিশেষ করে পাসপোর্ট অফিস, ভূমি অফিস, বিদ্যুৎ অফিস এবং পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদগুলোর দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।
দুদকের চেয়ারম্যান মো. মুনীর চৌধুরী সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সরকারি সেবা গ্রহণে জনগণ যেন হয়রানির শিকার না হয়, সেজন্য আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাব। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”