এলডিসি উত্তরণে মানবসম্পদ সূচকে খারাপ হচ্ছে বাংলাদেশের অবস্থান

বাংলাদেশ ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। এই লক্ষ্যে তিনটি আন্তর্জাতিক সূচকে ধারাবাহিকভাবে ভালো অবস্থানে থাকলেও সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মানবসম্পদ সূচকে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে দেশটি। তবে মাথাপিছু আয় ও অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে এখনও বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী।
তিনটি সূচক দিয়েই হয় এলডিসি উত্তরণের মূল্যায়ন
জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতি বিষয়ক কমিটি (সিডিপি) তিনটি সূচকের ভিত্তিতে এলডিসি থেকে উত্তরণের বিষয়টি মূল্যায়ন করে থাকে। এই সূচকগুলো হলো:
- মাথাপিছু আয়
- মানবসম্পদ সূচক (Human Assets Index)
- অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচক (Economic and Environmental Vulnerability Index)
বাংলাদেশ ২০১৮ ও ২০২১ সালের দুইবার ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে এই তিনটি সূচকের প্রতিটিতেই উত্তীর্ণ হয়েছিল, যা এলডিসি ইতিহাসে একক দৃষ্টান্ত। এর ভিত্তিতেই ২০২১ সালে বাংলাদেশকে ২০২4 সালে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ দেওয়া হয়। তবে কোভিড-১৯–এর কারণে প্রস্তুতির জন্য দুই বছরের সময়সীমা বৃদ্ধি করে তা ২০২৬ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
মানবসম্পদ সূচকে কমেছে পয়েন্ট
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর ২০২৫ সালের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, মানবসম্পদ সূচকে দেশের স্কোর কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। ২০২৪ সালে যেখানে এই সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৭৭.৫, ২০২৫ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭৭.১–তে। যদিও এটি এখনও এলডিসি উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় ৬৬ পয়েন্টের চেয়ে অনেক বেশি, তবে পতন একটি সতর্ক সংকেত বহন করছে।
এই সূচকে মূলত শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, সাক্ষরতার হার, লিঙ্গ সমতা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন বিবেচনা করা হয়। বিশেষত স্বাস্থ্য সূচক ২০২৪ সালে ছিল ৭৭ পয়েন্ট, যা এবার কমে দাঁড়িয়েছে ৭৫.৮–এ। এতে বোঝা যাচ্ছে, স্বাস্থ্য খাতে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি বা কিছু খাতে অবনতি ঘটেছে।
মাথাপিছু আয়ে বড় অগ্রগতি
মানবসম্পদ সূচকে কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি অব্যাহত আছে। ২০২৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, গত তিন বছরের গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২,৭৩৪ মার্কিন ডলার, যা এলডিসি উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় ১,৩০৬ ডলারের প্রায় দ্বিগুণ।
২০২৪ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ২,৬৮৪ ডলার, এক বছরের ব্যবধানে ৫০ ডলারেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণে এক বড় প্রাপ্তির পথে নিয়ে যাচ্ছে।
অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে স্থিতিশীলতা
অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান ইতিবাচক। ২০২৫ সালে এই সূচকে দেশের স্কোর দাঁড়িয়েছে ২১.৮, যা আগের বছরের ২১.৯ থেকে কিছুটা উন্নত। এই সূচকে ৩২ অথবা এর কম স্কোর অর্জন করতে হয় উত্তরণের জন্য।
এই সূচক নির্ধারণ হয় কৃষি, শিল্প ও সেবার জিডিপিতে অবদান, রপ্তানি নির্ভরতা ও অস্থিতিশীলতা, দুর্যোগের ঝুঁকি, কৃষি উৎপাদনের অস্থিরতা, উপকূলীয় এলাকায় জনসংখ্যার হার ইত্যাদি বিবেচনায়। যদিও বেশিরভাগ উপসূচকে তেমন উন্নতি হয়নি, তবে স্থিতিশীলতা ধরে রাখা গেছে, যা একটি ইতিবাচক দিক।
এলডিসি থেকে উত্তরণ কীভাবে হয়?
এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়া অত্যন্ত কাঠামোবদ্ধ। প্রতি তিন বছর অন্তর জাতিসংঘের সিডিপি এসব দেশের মূল্যায়ন করে। কোনো দেশ যদি একাধিক ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে অন্তত দুইটি সূচকে উত্তীর্ণ হয়, বা মাথাপিছু আয় নির্ধারিত সীমার দ্বিগুণ হয়, তাহলে সেই দেশকে উত্তরণের জন্য সুপারিশ করা হয়।
এরপর সেই সুপারিশ জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিল (ECOSOC)-এ পাঠানো হয়। প্রস্তুতির জন্য তিন বছর সময় দেওয়া হয়। প্রস্তুতি শেষে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে চূড়ান্ত অনুমোদনের পর সেই দেশ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
উত্তরণের সুফল ও চ্যালেঞ্জ
এলডিসি থেকে উত্তরণের মাধ্যমে একটি দেশের আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। এতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয়, বৈদেশিক ঋণের সুযোগ বাড়ে এবং রপ্তানিতে নতুন বাজার সৃষ্টি হয়।
তবে এর চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এলডিসি স্ট্যাটাস থাকলে বাংলাদেশ বিভিন্ন উন্নত দেশের কাছ থেকে শুল্কমুক্ত বা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা পায়। উত্তরণের পর এসব সুবিধা ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে, যা রপ্তানিকেন্দ্রিক শিল্পের জন্য চাপ তৈরি করতে পারে। এজন্য বাংলাদেশকে উত্তরণের প্রস্তুতি হিসেবে রপ্তানি বহুমুখীকরণ, দক্ষতা উন্নয়ন এবং অভ্যন্তরীণ শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে।