নারী সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবি হেফাজতের নতুন আন্দোলনের ঘোষণা

ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শনিবার (৩ মে) অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে নারী সংস্কার কমিশন বাতিলসহ মোট ১২ দফা দাবি উপস্থাপন করেছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতারা জানান, এই দাবিগুলোর মাধ্যমে দেশে ইসলামিক মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ন্যায়বিচার ও সাংবিধানিক সংশোধনের দাবি তোলা হয়েছে।
প্রধান দাবি: নারী সংস্কার কমিশন বাতিল ও নতুন কমিশন গঠন
সমাবেশে হেফাজতের নায়েবে আমীর মাওলানা মাহফুজুল হক ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়:
“নারী সংস্কার কমিশন বাতিল করতে হবে এবং তার পরিবর্তে আলেম ও নারী প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি নতুন কমিশন গঠন করতে হবে যা ইসলামী বিধানের আলোকে নারীর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করবে।”
এই দাবির পেছনে সংগঠনের যুক্তি হলো, বর্তমান কমিশনের প্রতিবেদন ‘ইসলামবিরোধী’ এবং ‘পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোকে ধ্বংসকারী’।
হেফাজতে ইসলামের ১২ দফা দাবি এক নজরে
১. নারী সংস্কার কমিশন ও প্রতিবেদন বাতিল, ইসলামপন্থী প্রতিনিধি নিয়ে নতুন কমিশন গঠন।
২. সংবিধানে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বহুত্ববাদ বাদ।
৩. ২০১৩ সালের শাপলা চত্বর এবং ২০২৩ সালের জুলাই গণহত্যার বিচার ও ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে গতি আনতে হবে।
৪. আওয়ামী লীগের বিচার ও দলীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা।
৫. চট্টগ্রামে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে নিহত সাইফুলের হত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত।
৬. শেখ হাসিনার শাসনামলে দায়েরকৃত রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার ও গুম-খুনের বিচারের দাবি।
৭. গাজায় হামলার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে শক্ত অবস্থান নেওয়া।
৮. প্রাথমিক থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ইসলামি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা।
৯. মানবিক করিডোর স্থাপন পরিকল্পনা থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে।
১০. পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশি এনজিও ও তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
১১. কাদিয়ানীদের (আহমদিয়া সম্প্রদায়) রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা।
১২. সাম্প্রদায়িকতা ও ইসলামী মূল্যবোধবিরোধী প্রচার বন্ধে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ।
আন্দোলনের পরবর্তী ধাপ: বিভাগীয় সম্মেলন ও বিক্ষোভ
সমাবেশে হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান আগামী তিন মাসের মধ্যে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ইসলামি মূল্যবোধ জোরদার করার লক্ষ্যে বিভাগীয় সম্মেলনের ঘোষণা দেন।
এছাড়া আগামী ২৩ মে সারা দেশে চার দফা দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হবে বলেও জানানো হয়।
সমাবেশে যোগদান ও সুশৃঙ্খল আয়োজন
ফজরের নামাজের পর থেকেই রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য জেলা থেকে হেফাজতের নেতাকর্মীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসতে শুরু করেন। হাজার হাজার অংশগ্রহণকারী শান্তিপূর্ণভাবে সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে সমাবেশে অংশ নেন।
হেফাজতের নেতারা এই সমাবেশকে ‘ধর্মীয় অধিকার ও জাতীয় আত্মপরিচয় রক্ষার লড়াই’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ‘ইসলাম ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে’ আহ্বান জানান।
এর আগে গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বাইতুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে মিছিল ও গণসংযোগ করে হেফাজতের নেতাকর্মীরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও প্রতিক্রিয়া
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, হেফাজতের এই ১২ দফা দাবি সরাসরি সরকারের নীতিমালার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। বিশেষ করে নারী সংস্কার কমিশন বাতিল ও কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার মতো দাবিগুলো সংবিধান ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দৃষ্টিকোণ থেকে বিতর্কিত।
তবে হেফাজতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের বিশ্বাস ও ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।”
সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতি
সমাবেশ ঘিরে রাজধানীতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশপাশের এলাকায় মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, “সমাবেশ শান্তিপূর্ণ ছিল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমরা সতর্ক অবস্থানে ছিলাম।”
হেফাজতে ইসলামের নতুন ১২ দফা দাবির মাধ্যমে একটি স্পষ্ট বার্তা এসেছে—তারা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংস্কারে সক্রিয় ভূমিকা নিতে চায়। তবে তাদের দাবিগুলোর বাস্তবায়ন সংবিধান, মানবাধিকার ও বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা নিয়ে বিতর্ক থাকছেই।
আগামী ২৩ মে’র বিক্ষোভ কর্মসূচি এবং বিভাগীয় সম্মেলনগুলোর মাধ্যমে সংগঠনটি কী ধরনের সাংগঠনিক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে, তা এখন দেখার বিষয়।