জাতীয়

বাংলাদেশে ৪৫ বছর: ইয়াংওয়ানের চেয়ারম্যান কিহাক সাংকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান

বাংলাদেশের শিল্পে অবদানের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাংকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়েছে। এই মর্যাদা তাকে প্রদান করেন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ৭৮ বছর বয়সী কিহাক সাং বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সাথে তার দীর্ঘ সম্পর্কের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাকে এই সম্মাননা দেওয়া হয়।

বাংলাদেশে কিহাক সাংয়ের অবদান

কিহাক সাংের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ৪৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে। আশির দশকে তিনি বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের শুরুতে একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রথম বিদেশি বিনিয়োগকারী, এবং তার হাত ধরেই এই শিল্পটি আন্তর্জাতিক বাজারে জায়গা করে নেয়। তিনি বাংলাদেশে একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, যার মাধ্যমে হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশে তার অবদান শুধু শিল্পে নয়, বরং বৃহত্তর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং শিল্পের বিকাশেও বিশেষভাবে প্রভাবিত। বর্তমানে কিহাক সাংয়ের ইয়াংওয়ান করপোরেশন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বিদেশি বিনিয়োগকারী, যার মাধ্যমে দেশের পোশাক শিল্পে বৈশ্বিক মান উন্নত হয়েছে।

সম্মানসূচক নাগরিকত্ব: এক বিশেষ স্বীকৃতি

যখন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কিহাক সাংকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়, তখন এটি শুধু তার ব্যক্তিগত অর্জন নয়, এটি বাংলাদেশের শিল্প খাতে তার অসামান্য অবদানকেও স্বীকৃতি দেয়। এই সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত ও সহজ করতে হবে। পাশাপাশি, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি নিরাপদ এবং সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। কিহাক সাংয়ের এই সম্মাননা বাংলাদেশের শিল্পে তার অবদানের সঙ্গেই মেলে।

ইয়াংওয়ান করপোরেশনের বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান

কিহাক সাংয়ের নেতৃত্বে ইয়াংওয়ান করপোরেশন বাংলাদেশে গড়ে তুলেছে একটি শক্তিশালী শিল্প সাম্রাজ্য। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় গড়ে তোলা কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (কেইপিজেড) এখন এক বিশাল শিল্প নগরী হয়ে উঠেছে। এখানে প্রায় ৭৩ হাজার কর্মী কাজ করেন, এবং ইয়াংওয়ানের বিভিন্ন কারখানায় প্রায় ১ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

এ ছাড়া, ইয়াংওয়ান করপোরেশন ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৮৬ কোটি ২৪ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে ৮০ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের পোশাক পণ্য ছিল। ইয়াংওয়ান করপোরেশন বাংলাদেশে পোশাক, জুতা, ব্যাগসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

কিহাক সাং: এক সফল উদ্যোক্তার জীবনযাত্রা

কিহাক সাংয়ের জীবনের শুরু ছিল খুবই সাধারণ। কোরিয়ায় তার বাবার ছিল কোল্ড স্টোরেজ ব্যবসা, কিন্তু তিনি সেই ব্যবসায় যোগ না দিয়ে নিজের পথ অনুসরণ করেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণ শেষে তিনি একটি পোশাক কারখানায় বিক্রয় নির্বাহী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কর্মজীবনের শুরুর দিকে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং পোশাক শিল্পের নানা দিক জানতে পারেন। এরপর তিনি উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের ব্যবসা শুরু করেন, এবং এই খাতে তিনি বিপুল সাফল্য অর্জন করেন।

কোরিয়া থেকে বাংলাদেশ: এক দীর্ঘ পথচলা

১৯৮০ সালে কিহাক সাং প্রথম বাংলাদেশে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে আসেন। তিনি ইয়াংওয়ান বাংলাদেশ লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন, এবং সেখানে কয়েক শত শ্রমিক নিয়ে কাজ শুরু করেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশী পোশাকের অবস্থান দৃঢ় হয়।

বর্তমানে, ইয়াংওয়ান করপোরেশন বাংলাদেশে একটি অন্যতম বৃহৎ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ইয়াংওয়ান করপোরেশন শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সাতটি দেশে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছে, এবং তার মধ্যে বাংলাদেশে তাদের সবচেয়ে বড় কার্যক্রম রয়েছে।

কীভাবে কিহাক সাং বাংলাদেশের বিনিয়োগ দূত হিসেবে কাজ করছেন

এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনে কিহাক সাং এক বিশেষ ভূমিকা পালন করছেন। তার নেতৃত্বে, কোরিয়া থেকে আরো অনেক বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশ সফরে নিয়ে আসা হয়েছে। এই সফরের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশে আরও বড় ধরনের বিনিয়োগ আনতে কাজ করছেন। কিহাক সাং এবং তার প্রতিষ্ঠান কোরীয় বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের সুযোগ-সুবিধা এবং সম্ভাবনা তুলে ধরতে সহায়তা করছেন।

এলাকার উন্নয়ন এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনা

চট্টগ্রামের আনোয়ারায় গড়ে তোলা কেইপিজেডে এক পরিবেশবান্ধব এবং আধুনিক শিল্প নগরী তৈরি হয়েছে। এখানে শ্রমিকদের জন্য হাসপাতাল, আবাসন সুবিধা, বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি, ১০০ শয্যার হাসপাতালসহ আরও একটি ৬০০ শয্যার হাসপাতাল এবং টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট নির্মাণ করা হচ্ছে।

এছাড়া, বর্তমানে জমি-সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হওয়ায় কেইপিজেডের আওতায় আরও বিদেশি বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা বেড়েছে।

কিহাক সাং বাংলাদেশের শিল্পে যে অবদান রেখেছেন, তা শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয়েছে। তার নেতৃত্বে ইয়াংওয়ান করপোরেশন যে পথপ্রদর্শক ভূমিকা পালন করেছে, তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তাঁর সম্মানসূচক নাগরিকত্ব বাংলাদেশের শিল্প খাতে তার দীর্ঘ সময়ের অবদানকে স্বীকৃতি দেয় এবং ভবিষ্যতে আরও অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারীর জন্য একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button