শেখ হাসিনার রায় ঘিরে বিচারক ও প্রসিকিউশনকে হত্যার হুমকি: ৩১৭ ভারতীয় সিমসহ গ্রেপ্তার ১
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঘোষিত রায়কে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারপতি ও প্রসিকিউশন দলের সদস্যদের ফোনে হত্যার হুমকি দেওয়ার ঘটনায় দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে যশোর থেকে বাবুল হোসেন (৩২) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যার কাছ থেকে ৩১৭টি ভারতীয় মোবাইল সিম কার্ডসহ অবৈধ ভিওআইপি সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। এই ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারিতে রয়েছে আরও বেশ কয়েকজন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তানভীর জোহা এই গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, নম্বরগুলো ভারতীয় হলেও ফোনগুলো করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকেই। এর আগে একই ঘটনায় ভোলা থেকে মো. শরীফ (২০) নামে আরও এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই হুমকি ও উসকানির ঘটনায় কয়েকটি ফেসবুক পেজ ও ব্যক্তিকে নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। শেখ হাসিনার রায়কে কেন্দ্র করে বিচার বিভাগকে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই এই হুমকিগুলো দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গ্রেপ্তার ও জব্দকৃত মালামাল
হুমকিদাতা হিসেবে অভিযুক্ত বাবুল হোসেনকে কীভাবে গ্রেপ্তার করা হলো এবং তার কাছ থেকে কী কী জব্দ করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার: সোমবার (২৪ নভেম্বর) ভোরে যশোর শহরের চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড কাঁচা বাজার মসজিদ গলি থেকে বাবুল হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাবুল হোসেন ঝিনাইদহের মহেশপুরের নোয়ালি গ্রামের মো. চাঁদ আলী বিশ্বাসের ছেলে।
ভিওআইপি অভিযান: যশোর কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক কাজী বাবুল হোসেন জানান, খন্দকার মিলনের বাড়িতে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তিনজন পালিয়ে গেলেও বাবুল হোসেনকে আটক করা সম্ভব হয়।
জব্দকৃত মালামাল: তার ঘর তল্লাশি করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে:
- ৩১৭টি ভারতীয় মোবাইল সিম কার্ড (৪৬টি ভিআই এবং ২৭০টি বিএসএনএল কোম্পানির)
- একটি কালো রঙের ভিওআইপি যন্ত্র
- একটি ডেল ল্যাপটপ
- দুটি বাংলাদেশি মোবাইল সিম
- একটি মোবাইল ফোন
হুমকির ধরন ও প্রক্রিয়া
বিচারক ও প্রসিকিউটরদের কীভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে এবং এর পেছনে ভারতীয় সিম ব্যবহারের উদ্দেশ্য।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রায় ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তিনজন বিচারপতি ও প্রসিকিউশন দলের সদস্যদের লক্ষ্য করে ফোন করে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
ভারতীয় সিমের ব্যবহার: জব্দকৃত সিম কার্ডগুলো ছিল ভারতীয় মোবাইল কোম্পানির। প্রসিকিউটর তানভীর জোহা নিশ্চিত করেছেন যে, নম্বরগুলো ভারতীয় হলেও ফোনগুলো করা হয়েছিল বাংলাদেশ থেকেই। ধারণা করা হচ্ছে, ভারতীয় সিম ব্যবহার করে ফোন করার মূল উদ্দেশ্য ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিভ্রান্ত করা এবং নিজেদের অবস্থান গোপন রাখা।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে উসকানি: শুধুমাত্র ফোন কলই নয়, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও বিচারপতি ও প্রসিকিউটরদের ছবি ব্যবহার করে হুমকিমূলক বার্তা প্রচার করা হয়েছিল।
গ্রেপ্তার ও তদন্তের পরিধি
বাবুল হোসেনের আগে আর কাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তদন্ত বর্তমানে কোন দিকে এগোচ্ছে।
- দ্বিতীয় গ্রেপ্তার: বাবুল হোসেনকে গ্রেপ্তারের আগে একই ঘটনায় গত ২০ নভেম্বর ভোলা থেকে মো. শরীফ (২০) নামে আরও এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
- শরীরের ভূমিকা: তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া বিভ্রান্তিকর ও উসকানিমূলক পোস্ট প্রচারে শরীফের সম্পৃক্ততা প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে।
- নজরদারি: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিচার সম্পর্কিত যেকোনো ধরনের হুমকি বা অপপ্রচার কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এই ঘটনায় বেশ কয়েকটি ফেসবুক পেজ এবং আরও কিছু ব্যক্তিকে নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।
- তদন্তের লক্ষ্য: তদন্তের প্রধান লক্ষ্য হলো এই হুমকির সঙ্গে জড়িত বাকি ব্যক্তিদের শনাক্ত করা এবং তাদের আইনি প্রক্রিয়ার আওতায় নিয়ে আসা।
শেখ হাসিনার রায় ও অপরাধের সারসংক্ষেপ
যে রায়কে কেন্দ্র করে এই হুমকি দেওয়া হচ্ছে, সেই মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার মূল তথ্য।
- মামলার বিষয়: গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করে।
- রায়: রায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং দুটি অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
- অন্যান্য দণ্ডিত: একই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনকে রাজসাক্ষী হওয়ায় শাস্তি কমিয়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
- সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত: রায়ে শেখ হাসিনা ও কামালের দেশে থাকা সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
বিচার বিভাগের নিরাপত্তা ও ভিওআইপি চ্যালেঞ্জ
বিচারক ও প্রসিকিউটরদের হুমকির ঘটনা এবং অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার আইনি দিক।
- বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: বিচারপতি ও প্রসিকিউটরদের হত্যার হুমকি দেওয়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আক্রমণ। এটি দেশের বিচার প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা নষ্ট করার একটি প্রচেষ্টা।
- অবৈধ ভিওআইপি: বাবুল হোসেনের কাছ থেকে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় সিমসহ ভিওআইপি সরঞ্জাম জব্দ করা প্রমাণ করে যে, এই হুমকির ঘটনায় অবৈধ টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা হয়েছে। ভিওআইপি রাজস্ব ফাঁকি এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য প্রায়শই ব্যবহৃত হয়।
- আন্তঃসীমান্ত অপরাধ: ভারতীয় সিম ব্যবহার করে হুমকি দেওয়ার এই ঘটনাটি আন্তঃসীমান্ত অপরাধমূলক কার্যক্রমের দিকে ইঙ্গিত করে। এই ধরনের অপরাধ মোকাবিলায় বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা জরুরি।
প্রসিকিউটর তানভীর জোহা : “নম্বরগুলো ভারতীয় হলেও ফোনগুলো করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকেই। হুমকিদাতাদের শনাক্ত এবং আইনি প্রক্রিয়ায় আনার জন্য আমাদের অভিযান চলছে।”
ষড়যন্ত্র রুখতে কঠোরতা
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শেখ হাসিনার রায়কে কেন্দ্র করে বিচারক ও প্রসিকিউশনকে হত্যার হুমকি এবং অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার প্রমাণ করে যে, একটি মহল বিচার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে এবং দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে মরিয়া। বাবুল হোসেনের কাছ থেকে ৩১৭টি ভারতীয় সিম কার্ড জব্দ হওয়ার ঘটনাটি এই ষড়যন্ত্রের আন্তর্জাতিক যোগসূত্রের দিকেও ইঙ্গিত করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত, এই ঘটনার মূল হোতাদের দ্রুত চিহ্নিত করা, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এই ঘটনায় জড়িত সকলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হলে ভবিষ্যতে বিচার বিভাগের ওপর এমন হুমকি দেওয়ার সাহস কেউ পাবে না।
এম আর এম – ২৩৯১,Signalbd.com



