জাতীয়

সেনাপ্রধান-ট্যাক্সিলা চেয়ারম্যান সাক্ষাৎ: প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদারে গুরুত্ব

Advertisement

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতরে আজ এক গুরুত্বপূর্ণ সৌজন্য সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়েছে। পাকিস্তানের সরকারি প্রতিরক্ষা শিল্প প্রতিষ্ঠান হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ ট্যাক্সিলা (এইচআইটি)–এর চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল শাকির উল্লাহ খাত্তাক এর নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এই সৌজন্য সাক্ষাৎকে ঘিরে দুই দেশের প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতার সম্ভাবনা এবং সামরিক আধুনিকায়নে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময় নতুন গুরুত্ব পেল।

পাকিস্তানের হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ ট্যাক্সিলা: পরিচিতি ও সামরিক উৎপাদন সক্ষমতা

হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ ট্যাক্সিলা (এইচআইটি) পাকিস্তানের অন্যতম বৃহৎ সামরিক শিল্প কারখানা, যা দেশটির ট্যাংক উন্নয়ন, সাঁজোয়া যান, সামরিক মেরামত, ভেহিকল আপগ্রেড, আর্টিলারি সিস্টেম, সুরক্ষা সরঞ্জাম এবং ডিফেন্স ইঞ্জিনিয়ারিং–এ বিশেষভাবে পরিচিত।

এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭১ সালের দিকে যাত্রা শুরু করলেও পরবর্তীতে সম্পূর্ণ আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিরক্ষা উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি আল-খালিদ ট্যাংক, আল-জারার ট্যাংক, সাঁজোয়া যুদ্ধযান, বারুদ প্রতিরোধী যান, সামরিক যানবাহনের আপগ্রেড এবং রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন সামরিক পণ্য উৎপাদন করে থাকে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ইতোমধ্যে এইচআইটি সামরিক প্রযুক্তি সহযোগিতা করেছে।

বাংলাদেশের সামরিক আধুনিকায়ন পরিকল্পনায় আলোচনার গুরুত্ব

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে সশস্ত্র বাহিনী উন্নয়ন পরিকল্পনা–২০৩০ এর আওতায় সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। নতুন সাঁজোয়া যান, উন্নত আর্টিলারি, আধুনিক নজরদারি ব্যবস্থা, রক্ষণাবেক্ষণ প্রযুক্তি ও আর্মার্ড ভেহিকল আপগ্রেডসহ বিভিন্ন প্রকল্প এগিয়ে চলছে।

এমন সময়ে এইচআইটি চেয়ারম্যানের এই সাক্ষাৎকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ পাকিস্তানের এইচআইটি অতীতে বাংলাদেশকে কিছু সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে এবং ভবিষ্যতে আরও সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে।

সাক্ষাৎকালে সম্ভাব্য আলোচ্য বিষয়সমূহ

সেনাসদরের উচ্চ পর্যায়ের এই বৈঠকে পারস্পরিক কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আলোচনায় আসতে পারে বলে সামরিক সূত্রগুলো ধারণা করছে—

১. সাঁজোয়া যান ও ট্যাংক প্রযুক্তি

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বর্তমানে আধুনিক সাঁজোয়া যান ও প্রধান যুদ্ধট্যাংক উন্নয়নে গুরুত্ব দিচ্ছে। পাকিস্তানের আল-খালিদ ও আল-জারার ট্যাংক অঞ্চলে পরিচিত। এদের আপগ্রেড প্রযুক্তি ও কারখানা–পর্যায়ের রক্ষণাবেক্ষণ বাংলাদেশে প্রয়োগযোগ্য হতে পারে।

২. সামরিক যান রক্ষণাবেক্ষণ ও আপগ্রেড সহযোগিতা

বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দেশের সামরিক যান ব্যবহার করছে—যা সময়মতো আপগ্রেড ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। এইচআইটি এ বিষয়ে বিশেষায়িত সক্ষমতা রাখে।

৩. প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর

সেনাবাহিনীর প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদদের প্রশিক্ষণ, কারিগরি জ্ঞান হস্তান্তর এবং যৌথ উদ্যোগে উৎপাদন বা আপগ্রেড–সংক্রান্ত আলোচনা হয়েছে বলে ধারণা।

৪. আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিষয়ক মতবিনিময়

দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশের সামরিক নেতৃত্ব আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি, সন্ত্রাস দমন, শান্তিরক্ষায় অবদানের ক্ষেত্রগুলো নিয়েও আলোচনা করতে পারে।

দুই দেশের সামরিক সম্পর্ক: পটভূমি

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সামরিক সম্পর্ক অত্যন্ত সীমিত হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পেশাদার পর্যায়ে যোগাযোগ ও প্রশিক্ষণ বিনিময় কিছুটা বেড়েছে।
বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বিশ্বের অন্যতম বড় বাহিনী হিসেবে পরিচিত, যার প্রশিক্ষণ, যানবাহন ও সরঞ্জাম উন্নয়নে বিভিন্ন দেশের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়।

অন্যদিকে পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন ও অভিজ্ঞ সামরিক বাহিনী হিসেবে সামরিক প্রযুক্তিতে অভিজ্ঞ। ফলে উভয় দেশের মাঝে প্রযুক্তি, পেশাগত প্রশিক্ষণ ও সামরিক শিল্প বিনিময়ের সুযোগ রয়েছে।

সৌজন্য সাক্ষাতের তাৎপর্য

আজকের সাক্ষাৎ শুধু প্রোটোকল নয়; এটি ভবিষ্যতের সহযোগিতার দ্বারও খুলে দিতে পারে। সামরিক কূটনীতিতে এমন সৌজন্য সাক্ষাৎ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে—

১. সামরিক কূটনীতি জোরদার

এ ধরনের সাক্ষাৎ আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করে।

২. প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে বিভিন্ন দেশের প্রযুক্তি প্রয়োজন। এইচআইটি সে সুযোগটি দিতে পারে।

৩. নতুন প্রকল্পের সম্ভাবনা

যৌথ উৎপাদন, গাড়ি আপগ্রেড প্রোগ্রাম, সামরিক যান রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদি আলোচনায় থাকতে পারে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

বাংলাদেশ তার সামরিক বাহিনীকে আন্তর্জাতিক মানে গড়ে তুলতে চীন, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সহযোগিতা করছে।
এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের এইচআইটি চেয়ারে­ম্যানের এই সফর সহযোগিতার ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত করতে পারে।

১. সাঁজোয়া যান শক্তিশালীকরণ

বাংলাদেশ বর্তমানে বিভিন্ন নতুন আর্মার্ড ভেহিকল প্রাপ্তি ও আপগ্রেড প্রক্রিয়ায় রয়েছে। পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে কাজে আসতে পারে।

২. আর্টিলারি আধুনিকায়ন

নতুন হাউইটজার, স্বয়ংচালিত আর্টিলারি ও মোবাইল আর্টিলারি যান প্রাপ্তিতে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা সম্ভব।

৩. কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি

সামরিক প্রকৌশলীরা নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রশিক্ষণ নিতে পারে পাকিস্তানে।

প্রতিনিধি দলের সফর–সূচি (সম্ভাব্য)

সাধারণত এ ধরনের সামরিক প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিট বা শিল্পকারখানা পরিদর্শন করে থাকে।
সম্ভাব্য সফরসূচিতে থাকতে পারে—

  • সেনাসদর পরিদর্শন
  • আর্মি ওয়ার্কশপ ও রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র পরিদর্শন
  • আর্মার্ড কোর বা আর্টিলারি কোরের সঙ্গে মতবিনিময়
  • প্রতিরক্ষা উৎপাদন সংশ্লিষ্ট ইউনিট পরিদর্শন
  • আনুষ্ঠানিক ডিনার বা অভ্যর্থনা

অর্থনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব

এইচআইটি–র সঙ্গে সম্ভাব্য সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধাও বয়ে আনতে পারে।
যেমন—

  • দেশে রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র নির্মিত হলে ব্যয় কমবে
  • বিদেশ থেকে যন্ত্রাংশ আমদানির উপর নির্ভরশীলতা কমবে
  • স্থানীয় প্রযুক্তিবিদদের কর্মসংস্থান বাড়বে
  • উন্নত সামরিক যান ব্যবহারের মাধ্যমে সেনাবাহিনী আরও দক্ষ হবে

আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট

দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিবেশ দিন দিন জটিল হচ্ছে। সীমান্ত নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ, জলসীমা নিরাপত্তা এবং শান্তিরক্ষা কার্যক্রম—সবক্ষেত্রেই অভিজ্ঞতা বিনিময় প্রয়োজন।
পাকিস্তানের সঙ্গে এমন আলোচনা আঞ্চলিক কৌশলগত প্রেক্ষাপটে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।

বৈঠকের সারসংক্ষেপ

আজকের বৈঠকে—

  • সৌজন্য বিনিময়
  • প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্ভাবনা
  • সামরিক প্রযুক্তি আদান-প্রদান
  • ভবিষ্যৎ সহযোগিতার কাঠামো
    এগুলোই মুখ্য ছিল বলে জানা যায়।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে এই উচ্চপর্যায়ের সৌজন্য সাক্ষাৎ ভবিষ্যৎ প্রতিরক্ষা সহযোগিতার একটি সম্ভাবনাময় দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
যে সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আধুনিকায়নের পথে এগোচ্ছে, সে সময় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তানের হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ ট্যাক্সিলা—দক্ষিণ এশিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য সামরিক উৎপাদন প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বাংলাদেশ–পাকিস্তান প্রতিরক্ষা সম্পর্ক নতুন গতি পেতে পারে।

সেনাবাহিনী সদর দফতরে অনুষ্ঠিত এই সৌজন্য সাক্ষাৎ তাই শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং সামরিক কূটনীতি ও ভবিষ্যৎ সহযোগিতা বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

MAH – 13949 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button