জাতীয়

নির্বাচনের আগে ঢাকায় কমনওয়েলথ মহাসচিব

Advertisement

বাংলাদেশের সামনে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন নির্বাচনী উত্তাপ ক্রমেই বাড়ছে, এর মধ্যেই ঢাকায় আসছেন কমনওয়েলথ মহাসচিব শার্লি বচওয়ে। আজ বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) শুরু হচ্ছে তার চার দিনের এই গুরুত্বপূর্ণ সফর, যা চলবে আগামী ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত। জাতীয় নির্বাচনের আগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগ্রহ ও সম্পৃক্ততা বাড়ার প্রেক্ষাপটে এই সফরকে অত্যন্ত অর্থবহ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকা এবং সহযোগিতা এখন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। সেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ঢাকায় কমনওয়েলথ মহাসচিবের উপস্থিতি বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে।

কমনওয়েলথ মহাসচিবের ব্যস্ত সূচি

চার দিনের এই সফরে শার্লি বচওয়ে সাক্ষাৎ করবেন—

  • অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস
  • অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টা
  • বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ
  • প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনের অন্যান্য সদস্য
  • বাংলাদেশে থাকা বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনার ও কূটনীতিক
  • নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি
  • ব্যবসায়ী সংগঠন ও তরুণ নেতৃত্বের প্রতিনিধিদের সঙ্গে

শুধু আনুষ্ঠানিক বৈঠক নয়, তিনি বিভিন্ন খাতের অংশীদারদের সঙ্গে মুক্ত আলোচনা, মতবিনিময় এবং কমনওয়েলথের নতুন কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ করবেন।

কমনওয়েলথের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সফরের কেন্দ্রবিন্দু থাকবে নির্বাচনকে ঘিরে শান্তি ও স্থিতিশীলতার পরিবেশ নিশ্চিত করা, গণতন্ত্র ও সুশাসনকে আরও শক্তিশালী করা এবং বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নকে কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় তা নিয়ে গভীর আলোচনা।

কমনওয়েলথ: বাংলাদেশের পুরনো ও ঘনিষ্ঠ অংশীদার

বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার অল্প কিছুদিন পরেই কমনওয়েলথে যোগ দেয়। যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ ৫৬টি দেশের এই সংগঠনে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র।
গত পাঁচ দশকে গণতন্ত্র, উন্নয়ন, নির্বাচন ব্যবস্থা, মানবাধিকার, পরিবেশ-বান্ধব নীতি ও বাণিজ্য—সব ক্ষেত্রেই কমনওয়েলথ বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে।

কমনওয়েলথ মহাসচিব বচওয়ে সফরের আগেই বলেন—

“স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ কমনওয়েলথ পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আমি বিভিন্ন অংশীদারের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে চাই এবং পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে সহযোগিতা জোরদারের পথ খুঁজে বের করতে চাই।”

তার ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিনের এই সম্পর্ক আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

কমনওয়েলথের নতুন কৌশলগত পরিকল্পনায় ‘গণতন্ত্র’ বড় অগ্রাধিকার

মহাসচিব শার্লি বচওয়ে তার সফরে কমনওয়েলথের নতুন স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানও উপস্থাপন করবেন, যার তিনটি প্রধান স্তম্ভ হলো—

  1. গণতন্ত্র ও সুশাসন
  2. টেকসই উন্নয়ন
  3. অন্তর্ভুক্তিমূলক শান্তি ও মানবাধিকারের সুরক্ষা

তিনি জানতে চান, বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোন ধরণের সহায়তা সবচেয়ে কার্যকর হতে পারে। বিশেষ করে—

  • নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিগত সহায়তা
  • পর্যবেক্ষক দল প্রেরণ
  • শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিতকরণে পরামর্শ
  • রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপকে উৎসাহ প্রদান
  • সুশাসন ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির উদ্যোগ
  • নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে সহযোগিতা

নির্বাচন সামনে: আন্তর্জাতিক মহলের বাড়তি নজর

বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহু আলোচনা চলছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা ইতোমধ্যেই তাদের মতামত জানিয়েছে।
গত মাসেই বাংলাদেশে এসেছিল কমনওয়েলথের একটি প্রাক-নির্বাচনী মূল্যায়ন দল, যারা রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সার্বিক পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করেন।

মহাসচিব বচওয়ের সফর সেই মূল্যায়ন মিশনেরই আনুষ্ঠানিক ধারাবাহিকতা।

কমনওয়েলথ জানায়—

“মহাসচিবের এই সফর বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ইতিবাচক ভূমিকার প্রতিফলন। আমাদের লক্ষ্য হলো শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ নির্বাচনকে সমর্থন করা।”

শান্তি, স্থিতিশীলতা ও জনগণের অধিকার—এবারও আলোচনার কেন্দ্রে

বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে মহাসচিব বচওয়ে বলেছেন—

“বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ নিশ্চিত করাই আমাদের অঙ্গীকার। আমরা চাই—প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং অংশগ্রহণের সুযোগ সুরক্ষিত হোক।”

তিনি আরও বলেন—

“বাংলাদেশ যখন নির্বাচন প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন আমরা দেশের জনগণের পাশে আছি। গণতান্ত্রিক যাত্রায় কমনওয়েলথের সমর্থন অব্যাহত থাকবে।”

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ—কী থাকতে পারে আলোচনায়

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে যেসব বিষয় গুরুত্ব পেতে পারে:

  • নির্বাচনকালীন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ
  • অবাধ ভোটাধিকার
  • প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা
  • ভোটারদের নিরাপত্তা
  • রাজনীতিতে সহনশীলতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা
  • নারী ও সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ
  • নির্বাচনী নিয়মাবলি শক্তিশালী করা
  • নির্বাচনী সহিংসতা রোধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সফর রাজনৈতিক অচলাবস্থাকে দূর করতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি ইতিবাচক বার্তা দেবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বৈঠকে গুরুত্ব পাবে কী

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে বৈঠকে আলোচনায় আসতে পারে—

  • নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি
  • আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
  • স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিতকরণ
  • মানবাধিকার পরিস্থিতি
  • মিডিয়া স্বাধীনতা
  • আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানোর উপায়

সফর-সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মহাসচিব বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণে কমনওয়েলথের ভূমিকা আরও কীভাবে শক্তিশালী হতে পারে তা নিয়েও আলোচনা করবেন।

কমনওয়েলথের নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ মিশন পাঠানোর সম্ভাবনা

বাংলাদেশে বড় নির্বাচনগুলোতে কমনওয়েলথ পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর ইতিহাস রয়েছে।
২০০৮ সালে বাংলাদেশে কমনওয়েলথের একটি বড় পর্যবেক্ষক দল কাজ করে, যা তখনকার ভোটের স্বচ্ছতা ও আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করেছিল।

২০২৬ সালের নির্বাচনেও এমন পর্যবেক্ষক দল আসতে পারে বলে কূটনীতিকদের ধারণা।
মহাসচিবের সফর সেই প্রক্রিয়াকে আরও এগিয়ে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের জন্য এ সফর কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সফর বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ—

১. নির্বাচনের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থার বার্তা
২. রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ বাড়াতে সহায়ক
৩. নির্বাচনী সহিংসতা ও অস্থিরতা কমাতে ভূমিকা রাখবে
4. গণতন্ত্র ও সুশাসন বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পেতে সহায়ক
5. দেশের কূটনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করবে

ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে যখন পুরো দেশ রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল সময় পার করছে, তখন কমনওয়েলথ মহাসচিবের এই সফর বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক আগ্রহ ও গুরুত্ব তুলে ধরছে।
এই সফর শুধু আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সফর নয়—এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, শান্তি ও সুশাসনকে আরও শক্তিশালী করার এক কৌশলগত সুযোগও বটে।

আগামী কয়েক দিনের বৈঠক, আলোচনা ও ফলাফল রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সাধারণ জনগণের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
সবচেয়ে বড় কথা—এই সফর নির্বাচনকে আরও শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় প্রত্যয়েরই প্রতিফলন।

MAH – 13892 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button