জাতীয়

সমবায়ভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুললে আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ সম্ভব: প্রধান উপদেষ্টা

Advertisement

৫৪তম জাতীয় সমবায় দিবসে প্রধান উপদেষ্টার বার্তা—‘সাম্য ও সমতায়, দেশ গড়বে সমবায়’

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো সমবায়ভিত্তিক অর্থনীতি। জনগণের অংশগ্রহণ ও পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে একটি আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব, যদি সমবায় ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করে সারাদেশে বিস্তৃত করা যায়।

শনিবার (১ নভেম্বর ২০২৫) ৫৪তম জাতীয় সমবায় দিবস উপলক্ষে এক বাণীতে তিনি এসব কথা বলেন। এবারের প্রতিপাদ্য— “সাম্য ও সমতায়, দেশ গড়বে সমবায়”

সমবায় খাতকে আধুনিক ও গতিশীল করার উদ্যোগ

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সমবায় খাতকে আধুনিক, স্বচ্ছ ও গতিশীল করতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কৃষি, মৎস্য, পশুপালন, ক্ষুদ্রঋণ, সঞ্চয়, কুটিরশিল্প ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে সমবায়ের ভূমিকা অপরিসীম। এই খাতগুলোর উন্নয়ন ঘটাতে পারলে আমরা সহজেই একটি আত্মনির্ভরশীল জাতিতে পরিণত হতে পারব।”

তিনি আরও বলেন, “গ্রামীণ সমাজের উন্নয়ন মানে শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক পরিবর্তনও বটে। সমবায়ের মাধ্যমে মানুষ শিখছে কিভাবে একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।”

সমবায়ের শক্তি: জনগণের অংশগ্রহণে উন্নয়ন

ড. ইউনূস তার বাণীতে উল্লেখ করেন, “দেশ ও জনগণের উন্নয়নে যেকোনো কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য সামাজিক সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। সমবায়ের অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমরা জনগণকে উন্নয়নের মূল ধারায় যুক্ত করতে পারি।”

তিনি মনে করেন, সমবায় শুধুমাত্র আর্থিক সংগঠন নয়—এটি একধরনের সামাজিক আন্দোলন। যেখানে মানুষ পারস্পরিক সহযোগিতা, সমতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ১ লাখেরও বেশি নিবন্ধিত সমবায় সমিতি রয়েছে, যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন প্রায় এক কোটি সদস্য। এসব সমিতি কৃষি উৎপাদন, পণ্য বিপণন, ক্ষুদ্রঋণ প্রদান, দারিদ্র্য বিমোচন ও নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

সমবায় আন্দোলনের ইতিহাস ও গুরুত্ব

বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলনের সূচনা ব্রিটিশ শাসনামলেই। ১৯০৪ সালে ‘কোঅপারেটিভ সোসাইটিজ অ্যাক্ট’ প্রণয়নের পর থেকেই গ্রামীণ অর্থনীতিতে সমবায়ের ধারণা ছড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার সমবায়কে উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে।

প্রফেসর ইউনূস বলেন, “বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের অন্যতম মূলনীতি ছিল—গ্রামীণ জনগণকে সংগঠিত করে সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে উৎপাদন ও বণ্টনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। আমরা সেই পথেই নতুনভাবে হাঁটতে চাই, আরও আধুনিক, স্বচ্ছ ও প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতিতে।”

আধুনিক প্রযুক্তিতে সমবায়ের রূপান্তর

বর্তমানে সরকার সমবায় সমিতিগুলোকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছে। অনলাইন নিবন্ধন, ডিজিটাল হিসাবরক্ষণ, স্বচ্ছ তহবিল ব্যবস্থাপনা এবং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তগ্রহণের জন্য একটি জাতীয় সমবায় তথ্যব্যবস্থা চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “সমবায় ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার শুধু দুর্নীতি রোধেই নয়, সদস্যদের আস্থা ও অংশগ্রহণও বাড়াবে। এতে গ্রামীণ জনগণ সরাসরি জাতীয় অর্থনীতির অংশীদার হতে পারবে।”

সমবায় ও নারীর ক্ষমতায়ন

নারী উন্নয়নে সমবায়ের ভূমিকা এখন অনেক বেশি দৃশ্যমান। বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে নারীরা ক্ষুদ্রঋণ, সঞ্চয় ও হস্তশিল্পভিত্তিক সমবায়ে যুক্ত হয়ে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

ড. ইউনূস বলেন, “নারীরা যদি সংগঠিত হয়, তবে তারা শুধু নিজের পরিবার নয়, পুরো সমাজকে এগিয়ে নিতে পারে। সমবায়ই তাদের সেই সংগঠিত শক্তি দিচ্ছে।”

কৃষিতে সমবায়ের গুরুত্ব

কৃষি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। এখানেই সমবায়ের সবচেয়ে বড় প্রয়োগ দেখা যায়। ছোট ও প্রান্তিক কৃষকরা একত্রিত হয়ে জমি ব্যবস্থাপনা, সেচব্যবস্থা, সার ও বীজ সংগ্রহে যৌথ উদ্যোগ নিলে উৎপাদন বাড়ে, খরচ কমে এবং লাভের ভাগও সমানভাবে বণ্টিত হয়।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা চাই কৃষকরা এককভাবে নয়, সমবায়ভিত্তিকভাবে কাজ করুক। এতে তারা বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারবে, পণ্যের সঠিক মূল্য পাবে এবং কৃষিতে স্থিতিশীলতা আসবে।”

অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই সমাজ গঠনে সমবায়

ড. ইউনূস তার বাণীতে আরও বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা বৈষম্যমুক্ত একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই।”

তিনি বলেন, “সমবায়ের মূল দর্শনই হলো—সবার জন্য সমান সুযোগ, সমান অংশগ্রহণ। এই নীতিই নতুন প্রজন্মের জন্য টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে।”

চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বাংলাদেশে সমবায় খাতের সম্ভাবনা যত বড়, চ্যালেঞ্জও ততটাই। অনেকে এখনো এটিকে সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারেননি। কোথাও কোথাও ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, নেতৃত্বের সংকট, সদস্যদের আস্থাহীনতা এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব দেখা যায়।

ড. ইউনূস বলেন, “আমরা এই সমস্যাগুলো সমাধানে গুরুত্ব দিচ্ছি। দক্ষ নেতৃত্ব তৈরি, নিয়মিত প্রশিক্ষণ, সুশাসন ও আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই সমবায় আবার মানুষের আস্থার জায়গা হয়ে উঠবে।”

সমবায়ের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন

বাণীর শেষে প্রধান উপদেষ্টা আহ্বান জানান—“আসুন, সমবায়ের চেতনাকে ধারণ করে সাম্য ও সমতায় আমরা সকলে মিলে গড়ে তুলি নতুন বাংলাদেশ। একটি দেশ যেখানে বৈষম্য থাকবে না, থাকবে সবার জন্য সমান সুযোগ ও মর্যাদা।”

তিনি ৫৪তম জাতীয় সমবায় দিবসের সব কর্মসূচির সার্বিক সফলতা কামনা করেন এবং সকল সমবায়ী ও দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানান।

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের পথে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলেছে। এই যাত্রায় সমবায়ভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামো হতে পারে অন্যতম চালিকাশক্তি। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে, তবে খুব শিগগিরই বাংলাদেশ আত্মনির্ভরশীল ও টেকসই উন্নয়নের এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে উঠবে।

MAH – 13566 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button