
বাংলাদেশে আজ থেকে শুরু হলো ইতিহাসের প্রথম সারাদেশব্যাপী টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি। এই কর্মসূচির আওতায় ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী প্রায় পাঁচ কোটি শিশু বিনামূল্যে ইনজেকটেবল টাইফয়েড টিকা পাবে। সরকারের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগকে শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষায় একটি “নতুন যুগের সূচনা” বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন আজিমপুরে
রোববার (১২ অক্টোবর) সকাল ৯টা ২০ মিনিটে রাজধানীর আজিমপুরে অবস্থিত স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা কেন্দ্রে এই মহাযজ্ঞের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মিজানুর রহমান, ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) প্রতিনিধি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং টিকাদান কর্মসূচির মাঠকর্মীরা।
টাইফয়েড: একটি প্রতিরোধযোগ্য ব্যাধি
টাইফয়েড হলো সালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে সৃষ্ট এক প্রাণঘাতী জ্বরজনিত রোগ, যা দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় এক কোটি মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে প্রায় এক লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়।
বাংলাদেশে এখনও প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার শিশুর টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ ও নিম্নআয়ের এলাকাগুলোতে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিচ্ছন্ন পানি, স্যানিটেশন ও টিকাদানের মাধ্যমে এই রোগ প্রায় সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা সম্ভব।
‘টাইফয়েডে শিশুর মৃত্যু আমাদের লজ্জার’ — নূরজাহান বেগম
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে নূরজাহান বেগম বলেন,
“টাইফয়েডে এখনও আমাদের শিশুদের মৃত্যু হয়—এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার। আমরা ডায়রিয়া, হাম, টিটেনাসের মতো বহু রোগে সফলভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি। এবার টাইফয়েড প্রতিরোধেও সফল হব ইনশাআল্লাহ।”
তিনি আরও বলেন,
“আমাদের এখন সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হলো রোগ প্রতিরোধ। যত বেশি শিশু টিকার আওতায় আসবে, তত কমবে হাসপাতালে ভিড়, চিকিৎসা খরচ এবং শিশুমৃত্যু।”
এক মাসব্যাপী বিনামূল্যের টিকাদান কর্মসূচি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই এক মাসব্যাপী জাতীয় ক্যাম্পেইন চলবে অক্টোবর মাস জুড়ে।
টিকা দেওয়া হবে ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী সকল শিশুদের।
জন্মসনদ না থাকলেও শিশু টিকা পাবে—কেউ বাদ যাবে না।
প্রতিটি শিশুকে দেওয়া হবে এক ডোজ ইনজেকটেবল টাইফয়েড টিকা (Typhoid Conjugate Vaccine – TCV)।
দেশের ৬৪টি জেলার ৬৮ হাজারেরও বেশি টিকাদান কেন্দ্র একযোগে এই কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে।
গ্রামীণ এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিক, স্কুল, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ইমাম ও সামাজিক নেতাদের সহযোগিতায় প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
শিশুস্বাস্থ্যের নতুন অধ্যায়
সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন,
“টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি শুধু একটি স্বাস্থ্য প্রকল্প নয়—এটি বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। বছরের পর বছর টাইফয়েড নীরবে অনেক শিশুর জীবন কেড়ে নিয়েছে। এবার আমরা তা বদলাতে পারব।”
তিনি অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানান,
“আপনার সন্তানকে টিকা দিন, এটি শুধু একটি ইনজেকশন নয়—এটি তার জীবনের সুরক্ষা।”
টিকার উৎস ও আন্তর্জাতিক সহায়তা
এই টিকা তৈরি করেছে ভারতের বিখ্যাত ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া।
বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন সহায়তা সংস্থা ‘গ্যাভি (Gavi)’-এর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় টিকাটি পেয়েছে।
গ্যাভির দক্ষিণ এশিয়া প্রধান ড. মাইকেল ওবির মতে,
“বাংলাদেশের এই পদক্ষেপ দক্ষিণ এশিয়ার জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি অনুপ্রেরণা। এটি ভবিষ্যতে টাইফয়েড নির্মূলে বৈশ্বিক প্রচেষ্টাকে আরও ত্বরান্বিত করবে।”
কেন টাইফয়েড টিকা জরুরি?
বিশেষজ্ঞদের মতে, টাইফয়েডের সাধারণ উপসর্গ যেমন জ্বর, মাথাব্যথা, ডায়রিয়া ও দুর্বলতা প্রায়ই অন্যান্য জ্বরের সঙ্গে মিশে যায়, ফলে অনেক ক্ষেত্রে রোগটি শনাক্ত হতে সময় লাগে।
অচিকিৎসায় এটি আন্ত্রিক ছিদ্র, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ, এমনকি মৃত্যুও ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের কারণে টাইফয়েড চিকিৎসা আরও জটিল হয়ে উঠছে। তাই টিকাদানই এখন সবচেয়ে কার্যকর ও সাশ্রয়ী উপায়।
কর্মসূচির বাস্তবায়ন পরিকল্পনা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, টিকা কার্যক্রম পরিচালনায় ১ লাখেরও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী অংশ নিচ্ছেন।
তাদের প্রশিক্ষণ, নিরাপদ ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও পরিবহন নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যে বিশেষ ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া স্কুলভিত্তিক টিকাদানেও জোর দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহায়তায় শিশুদের তালিকা তৈরি করে ধাপে ধাপে টিকা দেওয়া হবে।
জনসচেতনতা ও প্রচারণা কার্যক্রম
সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যমে টাইফয়েড প্রতিরোধে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু হয়েছে।
ইউনিসেফের সহযোগিতায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও “প্রতিটি শিশুর টিকা, সবার নিরাপদ ভবিষ্যৎ” শিরোনামে অনলাইন প্রচারণা চলছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আশা করছে, ৮০ শতাংশেরও বেশি শিশু টিকাদানের আওতায় আসবে।
বিশ্বব্যাপী টাইফয়েড টিকা: সফল উদাহরণ
বিশ্বের বহু দেশেই টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (TCV) সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, জিম্বাবুয়ে ও মালাউই ইতিমধ্যে জাতীয় পর্যায়ে এই টিকা কার্যক্রম চালু করেছে।
পাকিস্তানে ২০১৯ সালে শুরু হওয়া টিকাদান কর্মসূচির পর সেখানে টাইফয়েডের হার ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
বাংলাদেশে এই উদ্যোগ সফল হলে, দক্ষিণ এশিয়ায় এটি হবে টাইফয়েড নির্মূলের এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
বিশেষজ্ঞ মতামত
ডা. ফারহানা ইসলাম, সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ, বলেন—
“এই টিকা শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে এবং ভবিষ্যতে টাইফয়েডে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। এটি শুধু একটি স্বাস্থ্য উদ্যোগ নয়, এটি অর্থনৈতিক দিক থেকেও লাভজনক; কারণ চিকিৎসা ব্যয় হ্রাস পাবে।”
অভিভাবকদের জন্য পরামর্শ
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অভিভাবকদের বলছেন—
- টিকার পর হালকা জ্বর বা ইনজেকশন স্থানে ব্যথা হতে পারে, যা স্বাভাবিক।
- শিশুকে পর্যাপ্ত পানি ও বিশ্রাম দিন।
- টিকা নেওয়ার দিন শিশুর পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।
- সন্দেহজনক কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করুন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: জাতীয় টিকা কর্মসূচিতে স্থায়ী অন্তর্ভুক্তি
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি আগামী বছর থেকে জাতীয় টিকা কর্মসূচি (EPI)-এর স্থায়ী অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
অর্থাৎ, ভবিষ্যতে নবজাতকদের নিয়মিত টিকা সময়সূচির মধ্যেই টাইফয়েড টিকা যোগ করা হবে।
বাংলাদেশে সারাদেশব্যাপী টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি কেবল একটি স্বাস্থ্য উদ্যোগ নয়—এটি একটি জাতীয় আন্দোলন। এই পদক্ষেপ দেশের শিশুস্বাস্থ্যের মান উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদে গভীর প্রভাব ফেলবে।
টাইফয়েডমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে এই টিকাদান কর্মসূচি হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপদ ভিত্তি।
MAH – 13277 I Signalbd.com