
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের বরাদ্দ ও অর্থায়ন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, “শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা সবাই বলছে, কিন্তু সরকারের কাছে বাস্তব অর্থ কোথায়?” শিক্ষকরা দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্বে থাকলেও কম বেতনের কারণে তাদের জীবনের মান কমে যাচ্ছে। ড. সালেহউদ্দিন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ভুখা পেটে আর কতদিন শিক্ষকরা দেশ গড়ে তুলবেন?
সোমবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ডিএসই ভবনে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারক এবং বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, যিনি অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন।
সরকারি অর্থায়নের সংকট এবং কর ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা
ড. সালেহউদ্দিন বলেন, সরকারি অর্থায়নের অভাব একটি গুরুতর সমস্যা। “সরকার সবসময় বলে ‘এটা দাও, সেটা দাও’, কিন্তু বাস্তবে রাজস্ব আদায় খুবই কম। আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭.২ শতাংশ, যা উন্নত দেশের তুলনায় অনেক কম। মানুষ কর দেয়, কিন্তু সেবা পায় না। এর ফলে কর দেয়ার আগ্রহও কমে যায়।”
তিনি আরও বলেন, এনবিআরের কর্মীদের সেবা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ কর দিতে উৎসাহবোধ করে। সরকারি অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা ও কর আদায়ের ঘাটতির কারণে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ প্রয়োজনীয়ভাবে পৌঁছাতে পারছে না।
শিক্ষক বেতন ও শিক্ষার মান
অর্থ উপদেষ্টা মন্তব্য করেন, “শিক্ষকরা কম বেতনে কাজ করছেন। কেউ বলেন তারা ঠিক মতো পড়ান না, কিন্তু তাদের জীবনযাপন করার উপযুক্ত সুবিধা নেই। ভুখা পেটে আর কতদিন পড়াবেন শিক্ষকেরা?” তিনি শিক্ষকদের মর্যাদা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন।
বিশ্বব্যাপী শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ দেশ উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি। শিক্ষকরা শিশু ও কিশোরদের মানসিক, শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাই তাদের বেতন, সামাজিক নিরাপত্তা এবং প্রণোদনা বাড়ানো অতীব জরুরি।
অর্থায়নে বৈচিত্র্য: ট্যাক্স নির্ভরতা থেকে শেয়াবাজার
ড. সালেহউদ্দিন বলেন, দেশের অর্থায়ন শুধুমাত্র ট্যাক্সের ওপর নির্ভর করে চলতে পারবে না। আমাদের শেয়ারবাজার এবং সুকুক মার্কেটে বিনিয়োগের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি মালয়েশিয়ার সুকুক মার্কেটকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
সুকুক বন্ড ইস্যুতে তিনি সতর্ক থাকবার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, “সুকুক বন্ড অবশ্যই অ্যাসেট-বেইসড হতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীরা রিটার্ন পায়। সঠিক রিটার্নের ব্যবস্থা থাকলে বিনিয়োগকারীরা এতে আগ্রহী হবেন।”
তিনি উল্লেখ করেন, বেক্সিমকো সুকুক বন্ড বিষয়ে সঠিকভাবে নজরদারি করা প্রয়োজন। এতে অনিয়ম রোধ হবে এবং দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ আরও স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য হবে।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা
ড. সালেহউদ্দিন আরও বলেন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবি। “শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে অর্থায়ন না করলে দেশের ভবিষ্যৎ গঠনের কাজ থেমে যাবে। আমাদের শিক্ষকেরা দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছেন। তাদের উপযুক্ত বেতন ও সুবিধা দিতে হবে।”
তিনি জানান, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা না হলে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো যথাযথ সেবা দিতে পারবে না। এছাড়া শিক্ষার মানও অবনতি হবে, যা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে দেশের মানবসম্পদে।
কর-আদায়ের উন্নয়নে জনগণের বিশ্বাস বৃদ্ধির গুরুত্ব
ড. সালেহউদ্দিন মনে করিয়ে দেন, “মানুষ কর দেয়, কিন্তু সেবা পায় না। তাই কর দিতে মানুষের আগ্রহ কম। এনবিআরের কাজ শুধু রাজস্ব আদায় নয়, বরং মানুষকে সেবা প্রদান করে তাদের বিশ্বাস অর্জন করা। তখনই মানুষ কর দিতে আগ্রহী হবে।”
তিনি আন্তর্জাতিক উদাহরণ উল্লেখ করে বলেন, উন্নত দেশে কর-রাজস্ব ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জনগণের বিশ্বাস বৃদ্ধির কারণে অর্থায়ন শক্তিশালী। বাংলাদেশেও একই নীতি অনুসরণ করতে হবে।
সরকারের আর্থিক নীতি ও সংস্কার
অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, “সরকারকে শুধু বরাদ্দ বৃদ্ধি নয়, বরং আর্থিক নীতি ও সংস্কার প্রণয়ন করতে হবে। ট্যাক্স নির্ভরতা কমিয়ে বিনিয়োগ ও শেয়ারবাজারকে শক্তিশালী করতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ যেন কার্যকরভাবে পৌঁছায়, সে জন্য আর্থিক পরিকল্পনায় স্বচ্ছতা আনা জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, দেশে এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, বীমা খাত ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাজ সমন্বিত করতে হবে। এতে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মান উন্নত হবে।
সেমিনারে বিশেষ বক্তব্য
সেমিনারে উপস্থিত অন্যান্য অতিথিরা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও বিনিয়োগের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এখন অত্যন্ত জরুরি। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারক বলেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেন, “শেয়ারবাজারের কার্যক্রম স্বচ্ছ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হলে দেশের অর্থায়ন বৃদ্ধি পাবে। এতে শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সহায়তা হবে।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সুপারিশ
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সরকারের কাছে কয়েকটি সুপারিশ দেন:
- শিক্ষক বেতন বৃদ্ধি ও প্রণোদনা: শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
- স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি: হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমকে উন্নত করতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে।
- কর সংগ্রহ ও সেবার মান বৃদ্ধি: মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে কর আদায় বাড়াতে হবে।
- শেয়ারবাজার ও সুকুক মার্কেটের শক্তিশালীকরণ: ট্যাক্স নির্ভরতা কমিয়ে নতুন বিনিয়োগ উৎস তৈরি করতে হবে।
- সুকুক বন্ডে সতর্কতা: বিনিয়োগকারীদের রিটার্ন নিশ্চিত করতে অ্যাসেট-বেইসড বন্ড ইস্যু করতে হবে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আশা প্রকাশ করেন, এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্য খাত এবং দেশের অর্থনীতি সকল ক্ষেত্রে উন্নতি পাবে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শিক্ষাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য খাতকে আর্থিকভাবে সুরক্ষিত না করলে দেশের ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। শিক্ষকরা দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছেন, তাদের মর্যাদা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের অন্যতম দাবী। কর ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, শেয়ারবাজার ও সুকুক মার্কেটের বিকাশ এবং সরকারের প্রণীত অর্থনৈতিক নীতি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করলে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন সম্ভব।
শিক্ষক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রাপ্য মর্যাদা, শিক্ষার মান উন্নয়ন, আর্থিক নীতি সংস্কার—এগুলোই দেশের সমৃদ্ধি এবং মানুষের জীবনের মান বৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি।
MAH – 12948 I Signalbd.com