জাতীয়

ডেঙ্গুর ঢেউ আসছে আগস্টে, এখনই সতর্ক হোন

আগস্ট ও সেপ্টেম্বরেই ডেঙ্গুর প্রকোপ সর্বোচ্চ হতে পারে বলে আশঙ্কা গবেষকদের। জ্যামিতিক হারে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। জনসচেতনতা, পরিকল্পিত নগরায়ণ এবং সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া রক্ষা নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।


বাংলাদেশে আবারও বাড়ছে ডেঙ্গু জ্বরের আতঙ্ক। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুন মাসে আক্রান্তের সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে। গবেষক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগস্টে ডেঙ্গুর ভয়াবহ ঢেউ আসতে পারে। এখনই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

ডেঙ্গুর আসন্ন ঢেউ: কী বলছে গবেষণা?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, দেশের প্রায় সব জেলায় এডিস মশার ঘনত্ব আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ব্রেটো ইনডেক্স ২০ ছাড়িয়েছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মহামারির আগাম সতর্ক সংকেত। গবেষণা আরও বলছে, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বরগুনা, বরিশাল, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, গাজীপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায় ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

“ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগস্টে জ্যামিতিক হারে বাড়তে পারে, এখনই প্রস্তুত না হলে বিপদ অনিবার্য,” — অধ্যাপক কবিরুল বাশার, কীটতত্ত্ববিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

অতীতের অভিজ্ঞতা: ভয়াবহ ২০২৩ সাল

২০২৩ সাল ছিল ডেঙ্গুর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী বছর। সরকারি হিসাবে সে বছর ১ লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং ১০০০-এর অধিক প্রাণহানি ঘটে। ২০২৪ সালের তুলনায় এ বছর শুরু থেকেই আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। চলতি বছরের জুনেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন প্রায় ১২ হাজার মানুষ। বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ, কারণ বহু রোগী ঘরে বসেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।

কেন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে কর্তৃপক্ষ?

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় প্রশাসন নানা উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে তা দৃশ্যমান নয়। অনেক জায়গায় লার্ভা ধ্বংস কার্যক্রম নিয়মিতভাবে চলছে না। জনবল ও প্রযুক্তির অভাবে পর্যাপ্ত মনিটরিংও হচ্ছে না। নির্মাণাধীন ভবন, খোলা ড্রাম, প্লাস্টিকের বোতল ও ফুলের টবে জমে থাকা পানি হচ্ছে এডিস মশার প্রজননের মূল উৎস।

“শুধু ফগিং করলেই হবে না, মূল সমস্যার জায়গা – প্রজননস্থল ধ্বংস করতে হবে,” — জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. তাহমিনা ইসলাম।

জলবায়ু ও নগরায়ণের দায়

নিয়ন্ত্রণহীন নগরায়ণ, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, এবং অতিবৃষ্টি ডেঙ্গুর বিস্তারে ভূমিকা রাখছে। শহরের অনেক স্থানে কয়েক দিনের বৃষ্টিতে পানি জমে থাকে, যা কয়েক দিনের মধ্যেই মশার প্রজননস্থলে রূপ নেয়। নির্মাণাধীন ভবন, পরিত্যক্ত ভবনের ছাদ বা বেজমেন্টে জমে থাকা পানি বিশেষ ঝুঁকি তৈরি করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনও এডিস মশার বংশবিস্তারে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করছে। উচ্চ আর্দ্রতা ও উষ্ণ তাপমাত্রা মশার জীবনচক্র দ্রুত সম্পন্ন করতে সাহায্য করছে।

সাধারণ মানুষের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ

সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। নাগরিকরা যদি নিজের বাসা, ছাদ, বারান্দা, আঙিনা এবং আশপাশ পরিষ্কার না রাখেন, তবে ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়। বাড়িতে বা অফিসে জমে থাকা পানির পাত্র নিয়মিত ফেলে দেওয়া ও পরিষ্কার করা আবশ্যক।

বিশেষ করে বাচ্চাদের স্কুল ব্যাগ, খেলনা, ফুলের টব, ফ্রিজের ট্রে, এসির পানি নিষ্কাশনের জায়গাগুলোতে নিয়মিত নজরদারি জরুরি।

সমন্বিত কৌশলই একমাত্র পথ

ডেঙ্গু প্রতিরোধে শুধু ফগিং বা ওষুধ ছিটানো যথেষ্ট নয়। বাস্তবভিত্তিক ও বিজ্ঞাননির্ভর পরিকল্পনা দরকার। প্রতিটি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর হটস্পট চিহ্নিত করে নিয়মিত লার্ভা জরিপ ও ধ্বংস অভিযান চালাতে হবে।

সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, মসজিদ ও মন্দিরের চত্বরও মশামুক্ত রাখতে হবে। তথ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আগাম পূর্বাভাস দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।

জনসচেতনতা ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশন, রেডিও এবং মসজিদ-মন্দিরে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। স্কুল পর্যায় থেকে শুরু করে অফিস-আদালত—সব জায়গায় ডেঙ্গুবিষয়ক সচেতনতা কার্যক্রম চালানো দরকার। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্বাস্থ্যকর্মী ও এনজিওদেরও সক্রিয়ভাবে যুক্ত করতে হবে এই প্রক্রিয়ায়।

শেষ কথা

ডেঙ্গু এখন আর শুধু একটি মৌসুমি রোগ নয়; এটি একটি পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং নগর পরিকল্পনার সম্মিলিত সংকট। আগস্টের ভয়াবহ ঢেউ আসার আগে এখনই সময় সতর্ক হওয়ার। শুধু সরকারের নয়, প্রতিটি নাগরিকের সচেতনতা, দায়িত্বশীলতা এবং অংশগ্রহণই পারে এই সংকট থেকে আমাদের রক্ষা করতে।


আগস্টের আগেই সতর্ক হোন। প্রতিটি ফোঁটা জমে থাকা পানি হতে পারে প্রাণঘাতী। নিজের এবং সমাজের সুরক্ষায় এখনই গৃহীত হোক কার্যকর পদক্ষেপ।

এম আর এম – ০১৭৫, Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button