আমেরিকায় অভিবাসন নীতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকেই কঠোর ভিসা আইন, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও বিদেশি কর্মীদের ওপর অতিরিক্ত পর্যবেক্ষণের ঘোষণা করেছেন তিনি। সেই ধারাবাহিকতায় এবার আরও কঠোর হলো আমেরিকান ভিসা নীতি—যে নীতি সরাসরি প্রভাব ফেলবে ভারতীয় নাগরিকদের ওপর, বিশেষ করে প্রযুক্তি খাতে কর্মরতদের।
সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের (U.S. State Department) পক্ষ থেকে বিশ্বের সব মার্কিন দূতাবাসের উদ্দেশে পাঠানো একটি নির্দেশিকায় জানানো হয়েছে, তথ্য যাচাই (Fact Checking), অনলাইন সুরক্ষা (Online Safety), কনটেন্ট মডারেশন (Content Moderation), নিয়ম-নীতির অনুবর্তিতা (Compliance) এবং অনুরূপ প্রযুক্তি-সম্পর্কিত কাজে যুক্ত বিদেশি নাগরিকদের ভিসা অনুমোদনে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে—এই ধরনের পেশার আবেদনকারীদের ভিসা ‘কোনওভাবেই অনুমোদন করা যাবে না’।
এমন কঠোর নির্দেশ বিশ্বব্যাপী আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কারণ আমেরিকার টেক ইন্ডাস্ট্রিতে ভারতীয়দের আধিপত্য বহুদিনের, বিশেষ করে এইচ-১বি ভিসার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করা প্রযুক্তিবিদদের অধিকাংশই ভারতীয়।
নতুন ভিসা নিয়ম: কোন কোন পেশা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত?
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর যে পেশাগুলোর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে সেগুলো হলো—
- তথ্য যাচাই (Fact Checker)
- অনলাইন সুরক্ষা বা সাইবার সেফটি
- কনটেন্ট মডারেশন
- ডাটা রিভিউ এবং অ্যালগোরিদম ট্রেনিং
- সোশ্যাল মিডিয়া নীতি মেনে চলার পর্যবেক্ষণ (Compliance Monitoring)
- অনলাইন ক্ষতিকর তথ্য চিহ্নিতকরণ (Harmful Content Review)
এগুলো এমন ক্ষেত্র, যেখানে প্রচুর ভারতীয় প্রযুক্তিবিদ ইতোমধ্যে কাজ করছেন বা যুক্তরাষ্ট্রে চাকরির সুযোগের আশায় আবেদন করে থাকেন।
কেন এই পেশাগুলোকে ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ মনে করছে আমেরিকা?
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন—
- অনলাইন তথ্য যুদ্ধ ও নির্বাচন হস্তক্ষেপ নিয়ে আমেরিকার শঙ্কা বেড়েছে।
- বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে কনটেন্ট মডারেশন ঠিকমতো না হওয়ায় নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
- বিদেশি কর্মীরা সংবেদনশীল তথ্য পরিচালনা করেন—এতে ডাটা সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
- ট্রাম্প প্রশাসন ‘আমেরিকান জবস ফার্স্ট’ নীতি আরও শক্তভাবে চালু করতে চাইছে।
ভারতীয়দের ওপর প্রভাব: কেন সবচেয়ে বড় ধাক্কা ভারতের প্রযুক্তিখাতে?
বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভিসা-নির্ভর প্রযুক্তি কর্মীবাহিনী হলো ভারতের। প্রতিবছর প্রায় ৭৫–৭০% এইচ-১বি ভিসাই ভারতীয়রা পান। সিলিকন ভ্যালি, সিয়াটল, নিউ ইয়র্ক—সব টেক হাবে ভারতীয় কর্মীদের প্রভাব স্পষ্ট।
তবে নতুন নিয়ম কেন তাদের জন্য ভয়াবহ?
- ভারতীয় প্রযুক্তিবিদদের অনেকেই কনটেন্ট মডারেশন বা অনলাইন নিরাপত্তা-সম্পর্কিত কাজে যুক্ত।
- মেটা, গুগল, ইউটিউব, অ্যামাজন, বাইটড্যান্স, ওপেনএআই—সবখানেই ভারতীয়রা কনটেন্ট রিভিউ টিমে কাজ করেন।
- ট্রাম্প পূর্বেও এইচ-১বি ভিসা কঠোর করেছিলেন; এবার আরও কড়াকড়ির ফলে অনেকেই আবেদন করতে ভয় পাচ্ছেন।
- যারা চাকরির প্রস্তাবপত্র (Job Offer) পেয়েছিলেন, তাদের নিয়োগ পিছিয়ে যেতে পারে।
- অনেক প্রতিষ্ঠানে নতুন ভারতীয় নিয়োগ সাময়িকভাবে স্থগিত হয়েছে বলে জানা গেছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষণা: ‘মার্কিন নিরাপত্তা সবার আগে’
হোয়াইট হাউসের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন—
“আমরা এমন কোনও বিদেশি কর্মীকে ভিসা দেব না যারা মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। তথ্য যাচাই, অনলাইন সুরক্ষা ও কনটেন্ট মডারেশন—এসব খাতে বিদেশিদের নিয়োগ সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা প্রয়োজন।”
ট্রাম্প নিজেও সাম্প্রতিক এক সমাবেশে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন—
“আমরা আমেরিকানদের চাকরি ফিরিয়ে দেব। বিদেশি কর্মীদের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।”
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
বিভিন্ন অভিবাসন আইন বিশেষজ্ঞ ও প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মতে—
১. রাজনৈতিক কারণ
২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে অভিবাসন ইস্যু আবারও বড় রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোটারদের মন জয় করতে ট্রাম্প প্রশাসন ভিসা কঠোর করে দেখাতে চাইছেন যে তিনি “মার্কিন চাকরি রক্ষায় দৃঢ়”।
২. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) যুগে তথ্য সুরক্ষা অত্যন্ত সংবেদনশীল
AI-চালিত কনটেন্ট জেনারেশন, ডিপফেক, সাইবার আক্রমণ—এসবের কারণে আমেরিকা আরও সতর্ক হয়ে উঠেছে।
যেসব বিদেশি কর্মী কনটেন্ট মডারেশন বা ডাটা যাচাইয়ের কাজে যুক্ত, তারা গোপনে ডাটা ফাঁস করতে পারে—এমন শঙ্কা প্রকাশ করছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ।
৩. দাবি উঠেছে ‘টেক জবসকে দেশীয় কর্মীদের হাতে ফিরিয়ে দিতে’
বিশ্বের বহু আমেরিকান নাগরিক অভিযোগ করেছেন যে প্রযুক্তিখাতে বিদেশিদের উপস্থিতি এতটাই বেশি যে স্থানীয় কর্মীরা চাকরি পাচ্ছেন না।
নতুন এই নীতি সেই চাপ কমানোর অংশ।
ভারতীয় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর প্রতিক্রিয়া
টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসেস (TCS), ইনফোসিস, উইপ্রো, কপজেমিনি—প্রায় সব ভারতীয় আইটি জায়ান্টই আমেরিকার বাজারে বিশালভাবে নির্ভরশীল।
একাধিক সংস্থার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন—
- নতুন ভিসা নীতি তাদের ‘অপারেশনাল ব্যয়’ বাড়িয়ে দেবে।
- মার্কিন কর্মী নিয়োগে খরচ অন্তত ৪০–৫০% বেড়ে যাবে।
- অনেক প্রকল্প সময়মতো শেষ করতে সমস্যা হবে।
ইনফোসিসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন—
“কনটেন্ট মডারেশন, সাইবার সেফটি ও ডাটা রিভিউ—এগুলোতে ভারতীয় কর্মীদের অভিজ্ঞতা বিশ্বে অতুলনীয়। আমেরিকার নতুন সিদ্ধান্ত বাজারকে অস্থিতিশীল করতে পারে।”
কনটেন্ট মডারেশন খাতে আঘাত: কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?
কনটেন্ট মডারেশন হলো—
- ভুয়া তথ্য চিহ্নিত করা
- ক্ষতিকর পোস্ট মুছে ফেলা
- সহিংসতা বা ঘৃণাত্মক বক্তব্য শনাক্ত করা
- শিশু সুরক্ষা বিষয়ক কনটেন্ট ফিল্টার করা
- নির্বাচন-সম্পর্কিত তথ্য যাচাই
বিশ্বের ৭০% কনটেন্ট মডারেশন হয় ভারত, ফিলিপাইন ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মাধ্যমে। আমেরিকায় কর্মরত ভারতীয়দের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে এই খাতে বড়সড় সংকট দেখা দিতে পারে।
এইচ-১বি ভিসা: নতুন বাধা আরও কঠিন
এইচ-১বি হলো বিদেশি দক্ষ কর্মীদের যুক্তরাষ্ট্রে কাজের প্রধান ভিসা। নতুন নির্দেশিকায় বলা হয়েছে—
- তথ্য যাচাই বা কনটেন্ট মডারেশন পেশায় যুক্ত থাকলে
- ‘ডাটা সিকিউরিটি রিস্ক’ হিসেবে বিবেচিত হলে
- অনলাইনে রাজনৈতিক কনটেন্ট রিভিউয়ের অভিজ্ঞতা থাকলে
এইচ-১বি আবেদন প্রায় নিশ্চিতভাবেই প্রত্যাখ্যান করা হবে।
ভারতীয় আবেদনকারীদের ৩০–৩৫% এই খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত চাকরির জন্য আবেদন করেন বলে জানা গেছে। তাই এই নিয়ম তাদের জন্য বড় ধাক্কা।
সিলিকন ভ্যালির উদ্বেগ: দক্ষতা সংকট তৈরি হতে পারে
গুগল, মেটা, ওপেনএআই, অ্যাপল—সকলেই শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় প্রযুক্তিবিদের ওপর নির্ভরশীল।
একজন গুগল কর্মকর্তা জানান—
“বিদেশি কর্মীদের নিষিদ্ধ করলে আমেরিকার টেক ইন্ডাস্ট্রি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দক্ষ লোকের অভাব মারাত্মক সমস্যা তৈরি করবে।”
আগামী দিনে কী ঘটতে পারে?
বিশ্লেষকরা সম্ভাব্য কিছু চিত্র তুলে ধরছেন—
১. ভারতীয় প্রযুক্তিবিদরা কানাডা, ইউরোপ বা দুবাইয়ের দিকে ঝুঁকবেন
গত ৫ বছরে কানাডা ভারতীয়দের জন্য সবচেয়ে সহজ কর্মভিসা প্রদানকারী দেশ।
২০২৪–২০২৫ সালে ভারতীয় টেক কর্মীদের ৬০% কানাডায় গিয়েছে।
২. আমেরিকার টেক কোম্পানিগুলো চাপে পড়বে
তারা হয়—
- স্থানীয়দের উচ্চ বেতনে নিয়োগ দেবে
বা - তাদের বিদেশি শাখা (ইন্ডিয়া, সিঙ্গাপুর) থেকে দূরবর্তী কাজ পরিচালনা করবে।
৩. ট্রাম্প প্রশাসনের চাপ আরও বাড়তে পারে
অভিবাসন কঠোর করার মাধ্যমে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া হচ্ছে। তাই নিয়ম আরও কড়া হতে পারে।
৪. ভারত–আমেরিকা কূটনৈতিক টানাপোড়েন বাড়তে পারে
বিশেষ করে প্রযুক্তি খাতে দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ভারতীয়দের জন্য করণীয়: আইন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে—
- নতুন ভিসা ক্যাটাগরি খুঁজতে হবে (O-1, EB-1A, L-1 ইত্যাদি)
- চাকরির ভূমিকা থেকে ‘কনটেন্ট রিভিউ’ শব্দ সরাতে হবে
- আইনি পরামর্শ নিয়ে নির্দিষ্ট নথি প্রস্তুত করতে হবে
- নতুন দেশ বা রিমোট জবের সুযোগ বিবেচনা করতে হবে
ট্রাম্পের কঠোরতায় ভারতীয় প্রযুক্তিবিদদের সামনে অনিশ্চয়তার ভবিষ্যৎ
নতুন মার্কিন ভিসা নীতির ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভারতীয়রা—বিশেষত তথ্য যাচাই, অনলাইন সুরক্ষা, কনটেন্ট মডারেশন বা অ্যালগোরিদমিক রিভিউ খাতে কর্মরতরা। এই পেশাগুলোকে “উচ্চ নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ” তালিকায় রাখায় তাদের জন্য ভিসা পাওয়া এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি শিল্পও উদ্বিগ্ন—কারণ ভারতীয় দক্ষ কর্মীদের ছাড়া অনেক বড় প্রতিষ্ঠান সময়মতো কাজ শেষ করতে পারবে না।
ট্রাম্প প্রশাসনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট—মার্কিন নাগরিকদের চাকরি রক্ষা এবং নিরাপত্তা জোরদার। কিন্তু এর ফলে ভারতীয়দের পাশাপাশি আমেরিকান টেক কোম্পানিগুলোও গভীর সংকটে পড়তে পারে।
বিশ্ব প্রযুক্তি বাজার নতুন এক অনিশ্চিত সময়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে—যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অভিবাসন নীতি।
MAH – 14177 I Signalbd.com



