সারাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিনদিন জটিল আকার ধারণ করছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে নতুন করে ৫৬৭ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর ২০২৫) সকালে প্রকাশিত দৈনিক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গতকাল বুধবার সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত হাসপাতালগুলোতে যেসব ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ঘনবসতিপূর্ণ নগর এলাকায় বসবাস করেন। মৃত্যু হওয়া সাতজনের মধ্যে তিনজন পুরুষ ও চারজন নারী।
এই তথ্য ডেঙ্গুর বিস্তার যেমন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে তা-ই তুলে ধরে। গত কয়েক বছরে বহুবার ডেঙ্গু সংক্রমণ দেখা গেলেও এবারের পরিস্থিতি বিশেষজ্ঞদের মতে আরও উদ্বেগজনক।
বিভাগভিত্তিক ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু রোগী ভর্তির পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিভাগভিত্তিক চিত্র হলো—
- ঢাকা বিভাগ: ৯২ জন
- ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন: ১২৫ জন
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন: ৮৬ জন
- চট্টগ্রাম বিভাগ: ৮৬ জন
- বরিশাল বিভাগ: ৬৯ জন
- খুলনা বিভাগ: ৪১ জন
- ময়মনসিংহ বিভাগ: ৩৭ জন
- রাজশাহী বিভাগ: ২৫ জন
- রংপুর বিভাগ: ২ জন
- সিলেট বিভাগ: ৪ জন
ডেঙ্গু রোগীর ভর্তির তালিকা থেকে স্পষ্ট যে শুধু ঢাকা শহরই নয়, প্রায় প্রতিটি বিভাগেই ডেঙ্গুর সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য হারে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে নগরায়ন, মশা নিয়ন্ত্রণে শৈথিল্য, পানি জমে থাকা ও আবহাওয়া পরিবর্তনকে বিশেষজ্ঞরা এর অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন।
চলতি বছরের ডেঙ্গু চিত্র
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৩৭৭ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯২ হাজার ৭৮৪ জন। গত বছরগুলোর তুলনায় এ সংখ্যা ভয়াবহভাবে বেশি।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছর জুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকলেও বর্ষা ও পরবর্তী মৌসুমে এর বিস্তার কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়।
ঢাকা শহরসহ বড় শহরগুলোতে নির্মাণশিল্পের প্রসার এবং খোলা স্থানে পানি জমে থাকার ফলে এডিস মশা দ্রুত বংশবিস্তার করছে।
ডেঙ্গুর বিস্তার কেন বাড়ছে – বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই সতর্ক করে আসছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন, নগর ঘনত্ব বৃদ্ধি ও সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব ডেঙ্গুকে মহামারির রূপ দিচ্ছে। তাদের মতে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধুমাত্র কীটনাশক ছিটানো নয়, বরং সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
১. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বছরের বেশিরভাগ সময় আর্দ্রতা ও উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। এই আবহাওয়া এডিস মশার প্রজননের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে। ফলে আগে যেখানে ডেঙ্গু মৌসুমি ছিল, এখন প্রায় সারাবছরই দেখা যাচ্ছে।
২. নগর এলাকায় পানি জমে থাকা
নগরায়নের দ্রুত প্রসারের ফলে বহুতল ভবন নির্মাণ, ফেলে রাখা ড্রাম, খোলা ট্যাংক, নির্মাণকাজের পানি ইত্যাদিতে সহজেই এডিস মশা বংশবিস্তার করছে।
৩. সিটি করপোরেশনের সীমিত ব্যবস্থা
নিয়মিত ফগিং, লার্ভিসাইডিং ও সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ অনেক জায়গায় যথাযথভাবে না হওয়ায় সংক্রমণ রোধে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের।
৪. জনসচেতনার অভাব
ঘরোয়া পরিবেশে অপরিচ্ছন্নতা, খোলা পাত্রে পানি রাখা, ফুলের টবের তলায় পানি জমে থাকা—এসব কারণে ডেঙ্গু দ্রুত ছড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নাগরিকদের মধ্যে দায়িত্ববোধ বাড়ানো না গেলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে।
হাসপাতালে চাপ বাড়ছে, শয্যা সংকট
সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর চাপ দিনদিন বাড়ছে। অনেক হাসপাতালে নতুন ওয়ার্ড খোলা হচ্ছে। কোথাও কোথাও রোগী ভর্তির জন্য অপেক্ষা তালিকাও তৈরি করা হয়েছে।
ঢাকায় একাধিক হাসপাতালের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গু রোগীরা অধিকাংশই জ্বরের পাশাপাশি পানিশূন্যতা, প্লেটলেট কমে যাওয়া এবং বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে জটিলতা বেশি দেখা যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সতর্কবার্তা
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বিশেষত—
- তিন থেকে পাঁচ দিনের বেশি জ্বর
- চোখ লাল হওয়া
- শরীরে ব্যথা
- বমি বমি ভাব
- পেটে ব্যথা
- রক্তনালী ফেটে রক্তক্ষরণ
এসব দেখা দিলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা জরুরি। কারণ অনেক সময় রোগী জ্বর কমে যাওয়ার পরও জটিল অবস্থায় পৌঁছাতে পারেন।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়
স্বাস্থ্য অধিদফতর, সিটি করপোরেশন ও বিশেষজ্ঞরা প্রতিরোধে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন—
- বাসার চারপাশে পানি জমতে না দেওয়া
- পানি জমে থাকতে পারে এমন সব জায়গা পরিষ্কার রাখা
- ফুলের টব, ড্রাম, ফ্রিজের ট্রে নিয়মিত পরিষ্কার করা
- মশারি ব্যবহার করা
- ঘরে-বাইরে মশা প্রতিরোধক ব্যাবহার
- নির্মাণস্থলে পানি জমতে না দেওয়া
- প্রতিবেশীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি
এছাড়া স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়মিত মশা নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সারাদেশে জনস্বাস্থ্য উদ্বেগ: কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ?
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি একাধিকবার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ২০১৯, ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা শহরকে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিন ধরেই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
২০২৫ সালেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পর্যাপ্ত উদ্যোগ না নেওয়া হলে ভবিষ্যতে আরও বড় সংকট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে—
- স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় আগাম প্রস্তুতি
- মাঠপর্যায়ে সিটি করপোরেশনের নিয়মিত মনিটরিং
- নাগরিকদের সচেতনতা
- কার্যকর কীটনাশক ব্যবহার
- ঘরোয়া পরিবেশ পরিষ্কার রাখা
—এসব করণীয় বাস্তবায়িত না হলে মৃত্যুহার আরও বাড়তে পারে।
ডেঙ্গু এখন শুধু মৌসুমি সংকট নয়, বরং সারাবছরের জনস্বাস্থ্য হুমকি। গত ২৪ ঘণ্টায় সাতজনের মৃত্যু এবং ৫৬৭ জনের নতুন আক্রান্ত হওয়া পরিস্থিতির ভয়াবহতা আবারও সামনে এনেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন পর্যন্ত সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। একইসঙ্গে নাগরিকদের নিজেদের বাসা-বাড়ি, অফিস ও আশপাশ পরিষ্কার রাখার দায়িত্বও নিতে হবে।
MAH – 14026 I Signalbd.com



