নভেম্বরের প্রথম ১৮ দিনেই সিলেট বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়েছে একশ’ জন। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছে আরও ১৪ জন রোগী। ফলে চলতি মাসে এখন পর্যন্ত মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০২ জনে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় উদ্বেগজনকভাবে বেশি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
সিলেট স্বাস্থ্য দপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, বর্তমানে বিভাগের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৪ জন রোগী ভর্তি আছেন। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি—৫ জন। এছাড়া মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালে ২ জন, বড়লেখা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১ জন, হবিগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালে ২ জন, লাখাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২ জন এবং সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত সিলেট বিভাগে মোট ৪১৭ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে হবিগঞ্জে ২২২ জন, সিলেট জেলায় ৭৩ জন, মৌলভীবাজারে ৬৩ জন ও সুনামগঞ্জে ৫৯ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। গত ৮ অক্টোবর সুনামগঞ্জে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে, যা চলতি বছরের সিলেট বিভাগের প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র মৃত্যুর ঘটনা।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি কেন আবার খারাপ হচ্ছে?
বাংলাদেশে সাধারণত বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও গত কয়েক বছর ধরে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসেও রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন, শহরের অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন, নির্মাণকাজের বৃদ্ধি, প্লাস্টিক বর্জ্য জমে থাকা এবং অনিয়ন্ত্রিত জনবসতি—সব মিলিয়ে এডিস মশার বংশবিস্তারের আদর্শ পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও সতর্ক করে বলছেন, এবার ডেঙ্গু সংক্রমণের ধরন ও বিস্তার—উভয়ক্ষেত্রেই নতুন ধরণের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আগে যে এডিস মশা মূলত দিনে কামড়াত, এখন তারা দিন-রাত যেকোনো সময়েই মানুষকে কামড়াচ্ছে। এ আচরণগত পরিবর্তন ডেঙ্গু সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ঢাকার আইইডিসিআর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে—
- এডিস মশার জেনেটিক মিউটেশন হয়েছে
- নতুন ভ্যারিয়েন্ট মশার কামড়ানোর সময়সূচি পরিবর্তিত
- ঘরের ভিতরের অন্ধকার জায়গা, বাথরুম, স্টোর রুম ও নির্মাণাধীন ভবন—সবজায়গায় বংশবিস্তারের হার বেড়েছে
- শুষ্ক মৌসুমেও লার্ভা বেঁচে থাকতে পারছে
এ পরিস্থিতিকে বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন।
সিলেটের বিভিন্ন জেলায় পরিস্থিতি—বিস্তারিত চিত্র
বিশ্লেষণে দেখা যায়, সিলেট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে হবিগঞ্জ জেলা। সেখানে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২২২ জন।
ধাপে ধাপে জেলাভিত্তিক পরিস্থিতি হলো—
১. হবিগঞ্জ জেলা
- আক্রান্ত: ২২২ জন
- কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে:
- শহরে নির্মাণকাজ বৃদ্ধি
- ড্রেনেজ ব্যবস্থা দুর্বল
- বাজার ও আবাসিক এলাকায় পানি জমে থাকা
- হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বাড়লেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
২. সিলেট জেলা
- আক্রান্ত: ৭৩ জন
- সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় লার্ভা জরিপে বিপুল পরিমাণ এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে
- বহু আবাসিক এলাকায় ফ্ল্যাটের বারান্দা, রুফটপ, প্লাস্টিক ড্রাম, ফুলের টবে লার্ভা পাওয়া গেছে
৩. মৌলভীবাজার জেলা
- আক্রান্ত: ৬৩ জন
- চা বাগান এলাকায় ডেঙ্গুর তেমন প্রভাব না থাকলেও শহর এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে
৪. সুনামগঞ্জ জেলা
- আক্রান্ত: ৫৯ জন
- অক্টোবর মাসে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা এখানেই ঘটে
- দোয়ারাবাজার, ছাতক ও সদর উপজেলার জনবসতিপূর্ণ এলাকায় বেশি আক্রান্ত
স্বাস্থ্য বিভাগের সতর্কতা ও নির্দেশনা
সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক জানান, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়েও রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগ উদ্বিগ্ন। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা প্রশাসনকে কঠোরভাবে মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের মূল বার্তা—
- ঘরের ভেতর ও বাইরে ৫ মিনিট সময় দিলেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব
- জমে থাকা পানি ফেলে দিতে হবে
- ফুলের টব, ফ্রিজের ট্রে, পানির পাত্র, ড্রাম—সব শুকনো রাখতে হবে
- দিনে-রাতে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে
- সামান্য জ্বর হলেও পরীক্ষা করতে হবে
ডেঙ্গুর লক্ষণ—প্রাথমিক অবস্থায় যা নজরে রাখতে হবে
সাধারণ লক্ষণ
- হঠাৎ উচ্চ জ্বর
- মাথাব্যথা
- চোখের পিছনে ব্যথা
- শরীর ব্যথা
- বমি
- ক্ষুধামন্দা
গুরুতর অবস্থার লক্ষণ (ডেঙ্গু শক সিনড্রোম)
- পেটে তীব্র ব্যথা
- রক্তক্ষরণ
- শ্বাসকষ্ট
- প্রচণ্ড দুর্বলতা
এ লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে।
বিশেষজ্ঞ মতামত: “এবারের ডেঙ্গু দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে”
ঢাকার জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. নাসির উদ্দিন বলেন—
“এডিস মশার নতুন আচরণগত পরিবর্তন সংক্রমণের মাত্রা বাড়াচ্ছে। শুধু বর্ষাকাল নয়—এখন সারা বছরই ডেঙ্গুর ঝুঁকি রয়ে গেছে। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে আবহাওয়া তুলনামূলক আদ্র হওয়ায় লার্ভা জন্মানোর সুযোগ বেশি।”
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শায়লা সুলতানা বলেন—
“রোগীরা দেরিতে চিকিৎসা নিতে এলে জটিলতা বাড়ছে। অনেকে জ্বর কমলে ভাবেন যে ভালো হয়ে গেছেন। কিন্তু ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে জ্বর কমার সময়টাই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।”
দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপট: ২০২৫ সালে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি কেমন?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে—
- ২০২৫ সালে দেশের সার্বিক ডেঙ্গু আক্রান্তের হার গত বছরের তুলনায় ১৮–২২% বেশি
- বর্ষার সময়ের পরও আক্রান্তের ঢেউ চলমান
- ঢাকার বাইরে সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী—সব জায়গায় রোগীর সংখ্যা বাড়ছে
- এ বছর নতুন করে ডেঙ্গু সেরোটাইপ–৩ (DENV-3) এবং সেরোটাইপ–৪ (DENV-4) তুলনামূলক সক্রিয়
চিকিৎসকদের মতে, নতুন সেরোটাইপে আক্রান্ত রোগীদের শরীর দ্রুত জটিল অবস্থায় যেতে পারে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ
সিসিক জানিয়েছে—
- ৮৯টি ওয়ার্ডে বিশেষ লার্ভা ধ্বংস অভিযান চলছে
- বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে ৪,৩০০টির বেশি বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেছে
- নগরবাসীকে সতর্ক করতে মাইকিং, পোস্টার, সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছে
তবে নাগরিকদের অসচেতনতা এখনও বড় বাধা—বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বসতবাড়িতে কোথায় এডিস মশা সবচেয়ে বেশি জন্মায়?
সিলেট স্বাস্থ্য দপ্তরের জরিপে দেখা গেছে—
- ফুলের টব: ৩৯%
- ছাদের ড্রাম বা ট্যাংক: ২৬%
- খোলা প্লাস্টিক বোতল: ১৫%
- এসি-র পানি নিষ্কাশন পাইপের নিচে: ৭%
- ফ্রিজ ট্রে: ৪%
- নির্মাণাধীন ভবন: ৯%
এডিস মশা খুবই কম জায়গার স্বচ্ছ পানিতে জন্মায়—মাত্র এক চা-চামচ পানি থাকলেও লার্ভা বাঁচতে সক্ষম।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে যা জরুরি
যা অবশ্যই করতে হবে
- প্রতি ৩ দিনে জমে থাকা পানি ফেলে দিন
- ঘর–বাড়ি পরিষ্কার রাখুন
- ছাদের পানি জমে থাকা নিষিদ্ধ
- ব্যবহৃত টায়ার, বোতল, ড্রাম ঢেকে রাখুন
- স্কুল, কলেজ ও কর্মস্থলে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করুন
যা করা যাবে না
- ডেঙ্গু হলে নিজে নিজে ব্যথার ওষুধ খাওয়া যাবে না
- অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন—সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ
- বেশি পানি জমে থাকে এমন ফুলের টব ব্যবহার করা যাবে না
- লার্ভা পাওয়া গেলে অবহেলা করা যাবে না
সিলেটের ডেঙ্গু পরিস্থিতি—কোথায় যাচ্ছে?
বিশ্লেষকদের মতে—
- নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়েই যদি রোগীর সংখ্যা ১০০ ছাড়ায়
- এবং আবহাওয়া আর্দ্র থাকে
- তবে ডিসেম্বরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে
এ পরিস্থিতিকে তারা “দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য হুমকি” হিসেবে দেখছেন।
সিলেটের জলবায়ু, নির্মাণকাজ বৃদ্ধি, সচেতনতার অভাব ও নতুন ভ্যারিয়েন্ট—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
সিলেট বিভাগে নভেম্বরের ১৮ দিনে ১০২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হওয়া—শুধু সংখ্যার হিসাব নয়; এটি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বড় সতর্ক সংকেত। এডিস মশার আচরণ পরিবর্তন, জলবায়ুর প্রভাব এবং মানুষের সচেতনতার ঘাটতি—সব মিলে ডেঙ্গু এখন দেশের জন্য বছরব্যাপী ঝুঁকিতে পরিণত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
“মাত্র ৫ মিনিট সময় দিলেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব।”
সুতরাং ঘর–বাড়ি পরিষ্কার রাখা, জমে থাকা পানি ফেলে দেওয়া এবং মশা প্রতিরোধে সচেতন হওয়াই এখন সময়ের দাবি।
MAH – 13866 I Signalbd.com



