স্বাস্থ্য

সন্তানকে আবেগগত অবহেলা? ৮ লক্ষণ, সমাধান জানুন

Advertisement

শিশু হওয়ার পর আমাদের মায়ের-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কি শুধু শারীরিক দূরত্বই বাড়ে, নাকি আমাদের মানসিক ও আবেগীয় সংযোগও দুর্বল হয়ে পড়ে? বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শারীরিক দূরত্ব হতেই পারে, কিন্তু সেই পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ও শৈশবের আবেগপ্রবণ স্মৃতি আমাদের প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও আচরণে গভীর ছাপ ফেলে।

যেসব অভিভাবক বুঝতে পারেন না, তারা কখনো অবচেতনভাবে সন্তানকে ইমোশনালি অবহেলা করে। আজকের এই নিবন্ধে আমরা সেই লক্ষণ, সম্ভাব্য প্রভাব এবং সমাধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

‘গুড এনাফ’ মা-বাবা: সন্তানের জন্য নিখুঁত নয়, যথেষ্ট ভালোই যথেষ্ট

১৯৫৩ সালে ইংল্যান্ডের শিশুরোগ ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডোনাল্ড উড উইনিকট তাঁর বিখ্যাত বই Playing and Reality-এ প্রথম উল্লেখ করেন ‘The Good Enough Mother’ ধারণা। এর অর্থ, সন্তানের জন্য নিখুঁত মা বা বাবার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন এমন অভিভাবকের, যিনি সন্তান যখন তার আবেগের বা মানসিক সাহায্যের প্রয়োজন অনুভব করে, তখন সেই সাহায্য দিতে পারেন।

উইনিকট দেখিয়েছেন, যদি মা-বাবা সন্তানের আবেগ ও চাহিদার ৫০% সময় সাড়া দিতে পারেন, তবে সেটিকে যথেষ্ট ভালো বা ‘গুড এনাফ’ বলা যায়। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার লি হাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সুজান উডহাউজ-এর গবেষণায়ও এ বিষয়টি সমর্থিত হয়েছে।

এ থেকে বোঝা যায়, সন্তানের জন্য প্রয়োজনীয় হলো সময়, মনোযোগ এবং বোঝাপড়া, নিখুঁততার চেয়ে।

শৈশবের ইমোশনাল অবহেলা: এটি কী এবং কেন ক্ষতিকর

ইমোশনাল অবহেলা তখন ঘটে যখন অভিভাবকরা সন্তানের অনুভূতি, আবেগ বা আবেগপ্রবণ চাহিদাকে গুরুত্ব দেন না। সাধারণত সমস্যাগুলো দেখা দেয় যখন—

  • সন্তান কী অনুভব করছে, তা খেয়াল না করা
  • সন্তানের আবেগ নিয়ে প্রশ্ন করা বা বোঝার চেষ্টা না করা
  • ইমোশনাল মুহূর্তে পাশে না থাকা
  • সন্তানের আবেগকে গুরুত্ব না দেওয়া

বেশির ভাগ মা-বাবা জানেনই না যে তাঁরা সন্তানকে ইমোশনালি অবহেলা করছেন। তারা হয়তো শারীরিকভাবে সব কিছু করছে—খাবার, পোশাক, ঘর, খেলাধুলার সুযোগ—কিন্তু আবেগের জায়গা থেকে সন্তানকে প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দিতে ব্যর্থ।

এ ধরনের অবহেলা চোখে দেখা যায় না, তাই প্রায়ই বোঝা যায় না। যেসব প্রাপ্তবয়স্ক এটি ভোগ করেছে, তারা প্রায়ই নিজের মধ্যে কিছুটা ‘ভিতরের ফাঁক’ অনুভব করেন। কেউ কেউ এই কারণে বিষণ্নতা, অপরাধবোধ বা অস্থিরতার শিকার হন।

পরিবারে ইমোশনাল অবহেলার ৮টি লক্ষণ

যদি আপনার পরিবারে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো লক্ষ্য করেন, তাহলে হতে পারে সন্তান বা আপনিও ইমোশনালি অবহেলার শিকার:

  1. গভীর কথাবার্তার অভাব: পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ভাসা-ভাসা, কোনো বিষয়েই গভীর আলোচনা হয় না।
  2. অকারণ রাগ বা ক্ষোভ: কখনো কখনো মা-বাবার প্রতি অকারণ রাগ অনুভব করা।
  3. পরিবারে হতাশা: পারিবারিক অনুষ্ঠানে যেতে গেলে মানসিকভাবে হতাশ বোধ করা।
  4. কঠিন বিষয় এড়িয়ে যাওয়া: পরিবারের সমস্যাগুলো নিয়ে সরাসরি আলোচনা করা হয় না।
  5. ভাই-বোনদের মধ্যে প্রতিযোগিতা: এর কারণ কখনো স্পষ্ট নয়।
  6. ভালোবাসা প্রকাশের ঘাটতি: আদর-ভালোবাসা কাজের মাধ্যমে প্রকাশ হয়, কথায় বা আবেগে নয়।
  7. নেতিবাচক আবেগ দমন: নেতিবাচক অনুভূতিকে পরিবারে ‘বেআইনি’ মনে করা।
  8. বিচ্ছিন্নতা বা একাকিত্ব: পরিবারের মাঝে থেকেও মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন বা একাকিত্বের অনুভূতি।

ইমোশনাল অবহেলার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব

শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত, ইমোশনাল অবহেলার প্রভাব দেখা দিতে পারে বিভিন্নভাবে—

  • স্ব-সম্মান ও আত্মবিশ্বাসের অভাব
  • সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হওয়া
  • অস্থিরতা, হতাশা ও বিষণ্নতা
  • নিজের অনুভূতিকে বোঝার অক্ষমতা
  • সমস্যা সমাধানে সমস্যা

এই ধরনের অভিজ্ঞতা প্রাপ্তবয়স্ক জীবনেও প্রভাব ফেলে। অনেকেই অজান্তেই পুনরায় একই আচরণ পালন করে থাকেন।

কীভাবে মোকাবিলা করবেন: সমাধান ও পরামর্শ

পরিবার বা সন্তানকে পরিবর্তন করা সহজ নয়, তবে নিজেকে বদলানো সম্ভব। আপনি নিম্নলিখিত পরামর্শগুলো অনুসরণ করতে পারেন—

  1. অর্থপূর্ণ কথাবার্তা বলুন: পরিবারের সঙ্গে শুধু কথা বলুন না, সংবেদনশীলভাবে কথা বলুন।
  2. নিজের অনুভূতিকে স্বীকার করুন: আবেগকে দোষ বা অপরাধ মনে করবেন না।
  3. পরিবারে নিজের যত্ন নিন: নিজের মানসিক ও শারীরিক যত্নের গুরুত্ব দিন।
  4. কঠিন বিষয় নিয়ে আলোচনা করুন: সমস্যার মুখোমুখি হোন, এড়িয়ে চলবেন না।
  5. ভালোবাসা প্রকাশ করুন কথায়: শুধু কাজের মাধ্যমে নয়, কথার মাধ্যমে অনুভূতি দেখান।
  6. নেতিবাচক অনুভূতির সম্মুখীন হোন: দমিয়ে রাখার বদলে স্বাভাবিকভাবে মোকাবিলা করুন।
  7. সন্তানের সঙ্গে নিয়মিত সময় কাটান: দিনে অন্তত কিছু সময় সন্তানকে দৃষ্টি দিন।
  8. শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন: তাদের সমস্যা ও অনুভূতিকে গুরুত্ব দিন।

এই পরিবর্তনগুলো করলে পরিবারে একে অপরের সঙ্গে সংযোগ দৃঢ় হয়, সন্তান ও প্রাপ্তবয়স্করা মানসিকভাবে সুস্থ থাকে।

শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য বিশেষ টিপস

  • শিশুদের মানসিক উন্নয়নে নিয়মিত খোলামেলা আলাপ: শিশুর অনুভূতি জানুন, তাদের সঙ্গে খেলাধুলা ও গল্প বলুন।
  • প্রাপ্তবয়স্করা নিজেকে বোঝার চেষ্টা করুন: নিজের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করুন, প্রয়োজন হলে থেরাপি নিন।
  • পরিবারে ইতিবাচক আবেগের পরিবেশ তৈরি করুন: ধন্যবাদ, প্রশংসা, সান্ত্বনা প্রকাশ করুন।

শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত ইমোশনাল অবহেলা অত্যন্ত ক্ষতিকর। কিন্তু সচেতন উদ্যোগ, অর্থপূর্ণ যোগাযোগ ও আবেগপ্রবণ মনোযোগের মাধ্যমে পরিবারে সম্পর্কের দূরত্ব কমানো সম্ভব। “গুড এনাফ” হওয়া মানে নিখুঁত না হওয়া, বরং স্বাস্থ্য সচেতন ও সংবেদনশীল হওয়া।

আপনি যদি আজই শুরু করেন, পরিবার ও সন্তানের মানসিক সুস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারেন।

MAH – 13858 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button