দেশজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগজনক অবস্থায় থাকলেও নভেম্বর মাসে এসে পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ নিয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায়—শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত—ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে ১ হাজার ১৩৯ জন নতুন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
রোববার (১৬ নভেম্বর ২০২৫) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বলছে, বর্ষা শেষ হওয়ার পরও বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে না। বরং অক্টোবর–ডিসেম্বরে আক্রান্তের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যায়। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
ডেঙ্গুর বর্তমান চিত্র: কোথায় কত রোগী?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী,
- ঢাকায় নতুন ভর্তি রোগীর সংখ্যা এখনও বেশি।
- তবে ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতেও দ্রুত সংক্রমণ বাড়ছে।
বর্তমানে, সারাদেশের বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কয়েক হাজার। অনেক হাসপাতালেই আবার শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে মেডিসিন ও শিশু বিভাগে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ—DEN-1, DEN-2, DEN-3 ও DEN-4—মধ্য DEN-2 ও DEN-3 এই সময়ে বেশি সক্রিয় থাকে। এগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি মারাত্মক এবং রোগীর শরীরে জটিলতা বাড়াতে পারে।
মৃত্যুর সংখ্যা কেন বাড়ছে? বিশেষজ্ঞদের মতামত
চলতি বছরের শুরু থেকেই চিকিৎসকরা একাধিক কারণ চিহ্নিত করেছেন—
১. দেরিতে হাসপাতালে আসা
অনেক রোগী প্রথমে জ্বর হলে মনে করেন সাধারণ ভাইরাল। কয়েক দিন পর রক্তপাত, বমি, পেটব্যথা বা শ্বাসকষ্ট শুরু হলে হাসপাতালমুখী হন। তখন তাদের অবস্থার অবনতি ঘটে।
২. সঠিক পর্যবেক্ষণের অভাব
ডেঙ্গুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো জ্বর কমার পরের ২৪-৪৮ ঘণ্টা। এ সময়ে শরীরে প্লাজমা লিকেজের ঝুঁকি থাকে। অনেক রোগী এই সময়টাকে গুরুত্ব না দিয়ে বাসায় থাকেন, যা বিপদের কারণ হতে পারে।
৩. নতুন সেরোটাইপে আক্রান্ত হওয়া
গত বছর যাঁরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, এবার ভিন্ন সেরোটাইপে আক্রান্ত হলে জটিলতা বেশি দেখা যায়।
৪. পরিবেশগত কারণ
বৃষ্টির পর জমে থাকা পানি, নির্মাণাধীন ভবন, অব্যবহৃত পাত্র—এডিস মশার প্রজননস্থল বেড়ে গেছে। জলবায়ুর পরিবর্তনও মশার কার্যক্ষমতা বাড়িয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উদ্বেগ: সংক্রমণ বাড়বে আরও?
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে,
- দিনমজুর, শ্রমিক, শিক্ষার্থী, অফিস-আদালত ও গার্মেন্টস কর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ এখন বেশি দেখা যাচ্ছে।
- অনেক পরিবারেই একাধিক সদস্য একই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন, যা কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের ইঙ্গিত।
- শহরের পাশাপাশি গ্রাম ও জেলা পর্যায়ে সংক্রমণ দ্রুত ছড়াচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়মিত মশা নিধন ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম আরও জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছে।
হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়ছে
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ বড় হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন শত শত রোগী ভর্তি হচ্ছেন। বরিশাল, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলেও ডেঙ্গু পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে।
একাধিক চিকিৎসকের মতে,
- স্যালাইন অর্থাৎ ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টই ডেঙ্গুর প্রধান চিকিৎসা।
- শয্যা সংকটের কারণে রোগীদের অনেক সময় করিডর কিংবা স্বজনদের চেয়ারে বসে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
- স্যালাইনের পাশাপাশি নিয়মিত রক্তের প্লেটলেট পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি।
এডিস মশার বংশবিস্তার রোধে করণীয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৮০% ডেঙ্গু সংক্রমণই বাসাবাড়ি থেকে হয়। তাই ব্যক্তিগত সচেতনতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
যে কাজগুলো অবশ্যই করতে হবে—
- বাড়ির ভেতর-বাহিরে পানি জমতে না দেওয়া
- ড্রাম, ফুলদানি, কুলার, বালতি সপ্তাহে অন্তত একদিন পরিষ্কার করা
- নির্মাণাধীন ভবনে পানি জমা রোধ
- জানালায় নেট ব্যবহার
- সকালে ও সন্ধ্যায় মশা প্রতিরোধক ব্যবহার
- ঘুমানোর সময় মশারি টানানো
যে আচরণগুলো বিপদ বাড়ায়—
- বাসায় জমে থাকা পানিকে ‘তেমন কিছু নয়’ ভেবে ফেলে না দেওয়া
- জ্বর হলে ডেঙ্গু পরীক্ষা না করা
- রক্তপাত শুরু হওয়া পর্যন্ত দেরি করা
- নিজে অসুস্থ থাকলেও আশেপাশে মশা নিধন না করা
একজন রোগীর অভিজ্ঞতা: “শরীরটা যেন ভেঙে পড়ছিল”
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ৩২ বছর বয়সী একজন রোগী জানান,
“প্রথম দুই দিন জ্বর ছিল ১০৩ ডিগ্রি। ভাবলাম ভাইরাস জ্বর। তৃতীয় দিন শরীর ব্যথা, মাথা ঘোরা, চোখ ঝাপসা লাগায় পরীক্ষা করাতে গিয়ে জানতে পারি ডেঙ্গু। দেরি করলে হয়তো আরও বিপদ হতো।”
এ ধরনের অভিজ্ঞতা রোগীদের মধ্যে সাধারণ, যা দেরিতে চিকিৎসা নেওয়ার ঘটনাকে আরও স্পষ্ট করে।
সরকারি উদ্যোগ: জরুরি পরিকল্পনা ও পরামর্শ
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনগুলো ইতোমধ্যে একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে—
- প্রতিদিন মশা নিধন ফগিং
- লার্ভিসাইড ছিটানো
- হাসপাতালগুলোতে অতিরিক্ত শয্যা প্রস্তুত রাখা
- ডাক্তার ও নার্সদের জন্য বিশেষ নির্দেশনা
- সচেতনতা মাইকিং
- স্কুল-কলেজে স্বাস্থ্যবিধি প্রচার
এছাড়া, বিশেষজ্ঞ দল প্রতিদিন আক্রান্ত এলাকা পর্যবেক্ষণ করছে।
বিশেষ সতর্কতা: কোন লক্ষণ দেখলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিচের যেকোনো একটি লক্ষণ দেখা দিলে দেরি করা যাবে না—
- হঠাৎ রক্তপাত
- বমি বা বমি বমি ভাব
- প্রচণ্ড দুর্বলতা
- পেট ব্যথা
- শ্বাসকষ্ট
- প্রস্রাব কমে যাওয়া
- জ্বর কমে যাওয়ার পরও অবস্থা খারাপ হওয়া
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ইতিহাস বলছে, ২০১৯ ও ২০২৩ সালের পর ২০২৫ সালও সবচেয়ে বিপজ্জনক একটি বছর হয়ে উঠতে পারে।
- ২০১৯ সালে আক্রান্ত হয়েছিলেন প্রায় ১ লাখ মানুষ
- ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছিল ১৬০০-এর বেশি
- ২০২৫ সালে ইতোমধ্যে কয়েক হাজার মৃত্যু নিবন্ধিত হয়েছে (বিভিন্ন সূত্র)
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শীতকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে গেলেও পুরোপুরি নির্মূল হয় না। তাই বছরের যে কোনো সময়ই সতর্ক থাকা জরুরি।
সবশেষে যা জানা জরুরি
ডেঙ্গু এখন আর শুধু শহরের সমস্যা নয়, পুরো দেশের সমস্যা। মৃত্যুর খবর প্রতিদিনই বাড়ছে। তাই—
- জ্বর হলে দ্রুত পরীক্ষা
- বাড়িতে পানি জমতে না দেওয়া
- শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীদের বিশেষ যত্ন
- আশপাশ পরিস্কার রাখা
- অযথা ভয় না পাওয়া—তবে সতর্ক থাকা প্রয়োজন
দেশজুড়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদের সচেতনতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
MAH – 13831 I Signalbd.com



