স্বাস্থ্য

বাংলাদেশের রোগীদের নতুন চিকিৎসা গন্তব্য: তুরস্ক

Advertisement

বাংলাদেশি রোগীদের মধ্যে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার প্রবণতা নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরেই ভারত ছিল রোগীদের প্রধান চিকিৎসা গন্তব্য। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত যাওয়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এর পাশাপাশি থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন, মালয়েশিয়া এবং সৌদি আরবেও রোগীরা চিকিৎসার জন্য যান। কিন্তু এখন নতুন গন্তব্য হিসেবে যুক্ত হয়েছে তুরস্ক। বিশেষ করে বন্ধ্যত্ব দূরীকরণ, লিভার ও কিডনি প্রতিস্থাপন, হৃদরোগ, অর্থোপেডিকসসহ নানা জটিল চিকিৎসায় বাংলাদেশের রোগীরা দেশটির দুইটি নামকরা হাসপাতালে যাচ্ছেন।

বিদেশে চিকিৎসার প্রবণতা ও প্রয়োজন

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসা অবকাঠামো থাকলেও রোগীরা প্রায়শই সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায় বিদেশে যাত্রা করছেন। প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখের বেশি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। এদের প্রায় ৯০ শতাংশই কিডনি ও লিভার প্রতিস্থাপন, ক্যানসার, হৃদরোগ এবং বন্ধ্যত্বের চিকিৎসার জন্য বিদেশ যান।

দেশে বন্ধ্যত্ব রোগীদের জন্য সরকারি কোনো বিশেষায়িত হাসপাতাল নেই। গত কয়েক বছরে ২৫টি সহায়ক প্রজনন প্রযুক্তি আইভিএফ (ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) কেন্দ্র গড়ে তোলা হলেও অধিকাংশ রোগী এখনও ভারতকে পছন্দ করতেন। তবে এখন সেই রোগীদের নতুন গন্তব্য হলো তুরস্ক।

কিডনি রোগী সাব্বির সরকারের অভিজ্ঞতা

দুটি কিডনি অকার্যকর হয়ে পড়া সাব্বির সরকার (ছদ্মনাম) বাংলাদেশের নামকরা একটি বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস নিয়েছেন। তবে কিডনি প্রতিস্থাপনে তিনি দেশি হাসপাতালগুলোতে আস্থা রাখতে পারেননি। প্রথমে পাকিস্তানে নেওয়া হলেও সেখানে সংক্রমণ হার বেশি হওয়ায় পরে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ‘ওকান ইউনিভার্সিটি হসপিটাল’-এ প্রতিস্থাপন হয়।

সাব্বির সরকারের ছেলে রোম্মান বলেন, “দেশের হাসপাতালগুলোতে রোগীদের সঙ্গে যথাযথ ব্যবহার নেই, অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাধ্য করা হয়। অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে চিকিৎসায় আস্থা রাখা কঠিন। এজন্য বাধ্য হয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।”

তিনি আরও জানান, তুরস্কে কিডনি প্রতিস্থাপনের পর বাবা দ্রুত সুস্থ হয়েছেন। “তাদের হাসপাতালে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের মান সর্বোচ্চ, তাই চিকিৎসার ফলাফল খুবই ভালো। একমাস থাকার পর কিডনি প্রতিস্থাপনের পর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরেছেন বাবা ও কিডনিদাতা।”

চিকিৎসার খরচ সম্পর্কেও রোম্মান জানান, কিডনি প্রতিস্থাপনসহ অন্যান্য জটিলতা মিলিয়ে খরচ হয়েছে প্রায় ২৫ লাখ টাকা। তার মতে, সেবার মান অনুযায়ী এটি বেশি নয়। তুরস্কে ফলোআপও সহজ, প্রয়োজন হলে ভিডিওকলে পরামর্শ নেওয়া যায়।

তুরস্কে বাংলাদেশের রোগীদের চিকিৎসা সুবিধা

বাংলাদেশিদের তুরস্কে চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রে কাজ করছে তুরস্ক সরকারের অনুমোদিত একমাত্র মেডিকেল ট্যুরিজম কোম্পানি ‘টার্কিশডক’। এটি বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান। টার্কিশডক কেবল তুরস্কে চিকিৎসা নিতে আগ্রহীদের জন্য কাজ করে। এছাড়া ভ্রমণ ও বিজনেস ভিসার মাধ্যমে গিয়েও চিকিৎসা নেয়া যায়।

২০২৩ সালে টার্কিশডকের যাত্রা শুরু হলেও প্রথম রোগী গেল ২০২৪ সালের মার্চে। ওই বছরে ৩০ জন বাংলাদেশি তুরস্কে চিকিৎসা নিয়েছেন। চলতি বছরের ৮ অক্টোবর পর্যন্ত শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। আরও অন্তত ৩০ জন ভিসা পেলে যাচ্ছেন, এবং আরও অর্ধশত আবেদন রয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে তুরস্কমুখী রোগীর সংখ্যা ছয়গুণ বেড়েছে।

কোন হাসপাতালে চিকিৎসা হয়?

বাংলাদেশিরা মূলত ইস্তাম্বুলের ওকান ইউনিভার্সিটি হসপিটাল এবং মেডিকানা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। রোগীদের প্রায় ৭০ শতাংশ লিভার ও কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য গেছেন। এছাড়া বন্ধ্যত্ব দূরীকরণ, অর্থোপেডিক এবং অন্যান্য জটিল চিকিৎসা নেন।

তুরস্কের হাসপাতালগুলোতে ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট চালু এবং কিডনি দাতার রক্তের সম্পর্কের বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে বাংলাদেশিসহ বিশ্বের যে কেউ সহজে চিকিৎসা নিতে পারেন।

বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিকোণ

টার্কিশডকের কান্ট্রি হেড এম নুরুজ্জামান রাজু বলেন, “বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে, কিন্তু লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট এবং কিডনি প্রতিস্থাপনে এখনও পিছিয়ে। তাই রোগীরা তুরস্কে যাচ্ছেন। তুরস্কের হাসপাতালগুলোতে উন্নত ব্যবস্থাপনা ও সর্বনিম্ন সংক্রমণ হার নিশ্চিত করা হয়, যা রোগীদের দ্রুত সুস্থ হতে সহায়তা করে।”

তিনি আরও জানান, “তুরস্কে লিভার ও কিডনি প্রতিস্থাপনে সফলতার হার ৯৯ শতাংশের বেশি, মৃত্যুহার সর্বোচ্চ ১ শতাংশের মতো। ক্লোজ ল্যাপারেস্কপি সার্জারি ব্যবহার করা হয়, ফলে রোগীরা দ্রুত সুস্থ হয়। খরচের দিক থেকেও তুরস্ক সিঙ্গাপুর ও ভারত থেকে অনেক সস্তা।”

তুরস্কে চিকিৎসা ইসলামী শরীয়তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বন্ধ্যত্ব চিকিৎসায় স্বামী-স্ত্রীর নিজস্ব স্পার্ম ব্যবহার করা হয়, এবং অন্যান্য দেশগুলোর মতো অনৈতিক প্রক্রিয়া নেই।

চিকিৎসার খরচ ও ফলোআপ

  • লিভার প্রতিস্থাপন: ৪০ থেকে ৬৫ হাজার ডলার
  • কিডনি প্রতিস্থাপন: ২০ থেকে ২৫ হাজার ডলার
  • বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট: ৬২ হাজার থেকে ১ লাখ ডলার
  • বন্ধ্যত্ব চিকিৎসা: ৮–১০ লাখ টাকা, যা থাকার, খাওয়ার এবং যাতায়াতসহ

ফলোআপে রোগীকে দেশে না ফিরিয়ে চিকিৎসককে আনা হয়, ফলে অতিরিক্ত খরচ হয় না। ডিসেম্বরেও একজন সার্জন আসবেন।

চিকিৎসা প্রক্রিয়া সম্পর্কে এম নুরুজ্জামান রাজু বলেন, “রোগীর চিকিৎসার ইতিহাস আমাদের কাছে পাঠানো হলে তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে উপযুক্ত চিকিৎসা প্রক্রিয়া নির্ধারণ হয়। এরপর রোগীর সঙ্গে আলোচনা শেষে ভিসা প্রক্রিয়া শুরু হয়। সাধারণত ভিসা ২১ থেকে ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে পাওয়া যায়। গুরুতর রোগী হলে দ্রুত ভিসাও দেওয়া হয়।”

বাংলাদেশি রোগীদের বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারত, থাইল্যান্ড, চীন, সৌদি আরবের পাশাপাশি এখন তুরস্ক নতুন গন্তব্য। বিশেষ করে কিডনি ও লিভার প্রতিস্থাপন, বন্ধ্যত্ব চিকিৎসা ও অন্যান্য জটিল রোগের জন্য তুরস্কের হাসপাতালগুলো প্রফেশনাল, নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী।

টার্কিশডক-এর মাধ্যমে বাংলাদেশিরা তুরস্কে সহজেই চিকিৎসা নিতে পারছেন। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা, সর্বনিম্ন সংক্রমণ হার এবং ইসলামী শরীয়তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সেবা তুরস্ককে বাংলাদেশিদের জন্য নতুন চিকিৎসা গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

MAH – 13571 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button