বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দিন দিন বেড়ে চলেছে। শুধু গত একদিনেই দেশজুড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। সেই সঙ্গে নতুন করে ৯৮৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করলে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়তে পারে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ও রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা, যেখানে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে হাসপাতাল ভর্তি সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
এক নজরে আজকের পরিস্থিতি
রোববার সকাল ৮টা থেকে সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত (২৪ ঘণ্টায়) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নতুন ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৯৮৩। বিভাগীয় ভিত্তিতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা নিম্নরূপ:
- বরিশাল বিভাগ: ১৪১ জন
- চট্টগ্রাম বিভাগ: ১১১ জন
- ঢাকা বিভাগ (সিটি করপোরেশনের বাইরে): ১৭১ জন
- ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন: ২২৭ জন
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন: ১৩৩ জন
- খুলনা বিভাগ: ৬২ জন
- ময়মনসিংহ বিভাগ: ৪১ জন
- রাজশাহী বিভাগ: ৭৮ জন
- রংপুর বিভাগ: ১২ জন
- সিলেট বিভাগ: ৭ জন
এদিকে, গত এক দিনে ৯৭০ জন রোগী হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। চলতি বছর মোট ছাড়পত্র পাওয়া রোগীর সংখ্যা এখন ৬৩,৪১৪ জন।
চলতি বছর ডেঙ্গুর পরিসংখ্যান
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মোট ৬৬,৪২৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে মারা গেছেন ২৬৯ জন।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ মূলত বর্ষা ও বর্ষার পরবর্তী সময়ের কারণে বাড়ে। বৃষ্টির পর জমে থাকা জল, পানির ট্যাংক ও ঝুড়ি-ঝোপে বেগুনি এডিস মশার প্রজনন বৃদ্ধি পায়। এডিস মশা ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে এবং মানুষকে কামড়ের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ায়।
ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ ও সতর্কতা
ডেঙ্গু রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:
- হঠাৎ তীব্র জ্বর
- মাথা ব্যথা
- চোখের পেছনের ব্যথা
- জয়েন্ট ও মাসল ব্যথা
- চামড়ায় লাল র্যাশ
কিছু ক্ষেত্রে রোগী রক্তক্ষরণ, চুলকানি, এবং অপ্রত্যাশিত শারীরিক দুর্বলতা অনুভব করতে পারে। যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন:
- পরিষ্কার পানি ব্যবহার করুন – স্থায়ীভাবে ট্যাংক ও পাত্রে জমে থাকা পানি ফেলে দিন।
- মশার থেকে সুরক্ষা – মশারি ব্যবহার, স্প্রে ও লাইট কাপড় ব্যবহার করুন।
- ডাক্তারের পরামর্শ নিন – জ্বর বা অস্বাভাবিক শারীরিক অবস্থার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে দ্রুত যান।
ঢাকা: ডেঙ্গুর হটস্পট
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন হল দেশের সবচেয়ে সংক্রমিত অঞ্চল। বিশেষ করে, ঢাকার যেসব এলাকা পানি জমে থাকার কারণে মশার প্রজনন সহজ, সেখানে সংক্রমণ দ্রুত ছড়াচ্ছে।
- ঢাকা উত্তর সিটি: ২২৭ জন নতুন ভর্তি
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি: ১৩৩ জন নতুন ভর্তি
এই সংখ্যা রাজধানীতে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার চাপ বৃদ্ধি করছে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত বেড না থাকায় রোগীরা প্রায়শই হেল্পলাইন ও বাড়িতে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
বিভাগীয় দিক থেকে পরিস্থিতি
ডেঙ্গু শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ নয়। দেশের বিভিন্ন বিভাগেও নতুন রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য:
- বরিশাল বিভাগ: ১৪১ জন
- চট্টগ্রাম বিভাগ: ১১১ জন
- খুলনা বিভাগ: ৬২ জন
- ময়মনসিংহ: ৪১ জন
- রাজশাহী: ৭৮ জন
- রংপুর ও সিলেট: ১৯ জন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংখ্যা শুধুমাত্র হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা, অর্থাৎ অনেক রোগী বাড়িতেও চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং সেগুলো পরিসংখ্যানে ধরা পড়েনি। ফলে বাস্তব পরিস্থিতি আরও গুরুতর হতে পারে।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ড সম্প্রসারণ, জরুরি চিকিৎসা সেবা, মশক নিধন কার্যক্রম চালাচ্ছে। এছাড়াও:
- জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা
- স্কুল ও কলেজে স্বাস্থ্য শিক্ষা
- সামাজিক মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতা
- স্থানীয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তিগত সতর্কতাও জরুরি, নাহলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।
নাগরিকদের করণীয়
ডেঙ্গু প্রতিরোধে নাগরিকদের করণীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা:
- জমে থাকা পানি ফেলে দিন – গাড়ি, টিউবওয়েল, বালতি, flower pot এ পানি জমে না থাকে।
- মশারি ও স্প্রে ব্যবহার করুন – রাতে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার অপরিহার্য।
- ডেঙ্গু লক্ষণ বুঝুন – জ্বর, মাথাব্যথা, চোখের পেছনের ব্যথা দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে যান।
- পরিবারে সচেতনতা বাড়ান – বয়স্ক ও শিশুদের বিশেষভাবে নজর রাখুন।
দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বর্তমানে উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। শুধুমাত্র একদিনে ৬ জনের মৃত্যু এবং ৯৮৩ জনের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এই রোগের গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা।
ঢাকা এবং বড় শহরগুলোতে ডেঙ্গুর হটস্পট তৈরি হওয়ায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চাপের মুখে। সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ মিলে যদি সতর্কতা অবলম্বন করা হয়, তবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
নাগরিকরা সচেতন না হলে, এই রোগ আরও বিস্তৃতভাবে ছড়াতে পারে, যা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে শুধুমাত্র চিকিৎসা নয়, জনসচেতনতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
MAH – 13504 I Signalbd.com



