স্বাস্থ্য

ডেঙ্গুতে আরও ৪ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮১৪ জন

Advertisement

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দিন দিন বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এডিস মশাবাহিত এই প্রাণঘাতী রোগে আরও ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর ফলে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫৩ জনে। একই সময়ে সারা দেশে নতুন করে ৮১৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদন

মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) বিকেলে হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নতুন আক্রান্ত ৮১৪ জন রোগীর মধ্যে—

  • ঢাকা মহানগরীতে: ২৭৭ জন
  • ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে): ১২৪ জন
  • চট্টগ্রাম বিভাগে: ১১৪ জন
  • বরিশাল বিভাগে: ১২৬ জন
  • খুলনা বিভাগে: ৪১ জন
  • ময়মনসিংহ বিভাগে: ৪৬ জন
  • রাজশাহী বিভাগে: ৪০ জন
  • রংপুর বিভাগে: ৪১ জন
  • সিলেট বিভাগে: ৫ জন

ভর্তি হয়েছেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত মোট ৬১ হাজার ৬০৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগই আগস্ট থেকে অক্টোবর সময়কালে শনাক্ত হয়েছেন—যা ডেঙ্গুর মৌসুম হিসেবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়।

গত বছরের তুলনায় পরিস্থিতি কেমন

২০২৪ সালের একই সময়ে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৮০ জন, আর আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০ হাজারের মতো। তুলনামূলকভাবে ২০২৫ সালে সংক্রমণের হার ও মৃত্যুর সংখ্যা দুটোই বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়া পরিবর্তন, বৃষ্টিপাতের অনিয়মিত ধারা এবং নাগরিক এলাকাগুলোর জলাবদ্ধতা ডেঙ্গু বিস্তারের অন্যতম কারণ।

চিকিৎসকদের সতর্কবার্তা

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন বলেন,

“ডেঙ্গুর প্রাথমিক উপসর্গকে অবহেলা করা এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। অনেকে জ্বর কমে গেলে ভাবে ভালো হয়ে গেছে, কিন্তু দ্বিতীয় ধাপে প্লেটলেট হঠাৎ কমে গিয়ে জটিলতা তৈরি হয়।”

তিনি আরও জানান, সামান্য জ্বর, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, চামড়ায় র‍্যাশ বা রক্তপাতের মতো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

দেশজুড়ে হাসপাতালের চাপ

ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ বিভিন্ন অঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড় বেড়ে গেছে।
বিশেষ করে রাজধানীর মুগদা, ঢাকা মেডিকেল, এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নতুন রোগীদের জন্য বেড পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
সরকারি হিসেবে জানা গেছে, বর্তমানে সারাদেশের ৫০০-রও বেশি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা চলছে।

মুগদা হাসপাতালের পরিচালক জানান—

“আমরা প্রতিদিন গড়ে ৭০ থেকে ৮০ জন নতুন রোগী ভর্তি নিচ্ছি। শিশু ও প্রবীণ রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বাড়ালেও চাপ এখনো অনেক।”

প্রতিরোধই একমাত্র উপায়

ডেঙ্গু রোগের কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ বা ভ্যাকসিন এখনো বাংলাদেশে পাওয়া যায়নি। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিরোধই সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

এডিস মশা সাধারণত পরিষ্কার স্থির পানিতে ডিম পাড়ে—যেমন ফুলের টব, ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার, পানির ট্যাংক, ছাদের পাত্র ইত্যাদিতে।
সপ্তাহে অন্তত একবার এসব জায়গা পরিষ্কার রাখা বা ফেলে দেওয়া উচিত।

স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, প্রতিটি পরিবারের উচিত:

  1. সকালে ও বিকেলে ঘরের ভেতর-বাইরে মশা মারার স্প্রে ব্যবহার করা।
  2. ফুলের টব ও বালতিতে জমে থাকা পানি ফেলে দেওয়া।
  3. জানালা-দরজায় জালি লাগানো।
  4. পূর্ণ হাতা জামা ও প্যান্ট পরিধান করা।
  5. শিশুদের স্কুলে পাঠানোর সময় মশার প্রতিরোধক ক্রিম ব্যবহার করা।

স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগ

ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে অভিযান জোরদার করেছে।
প্রতিদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মশক নিধন কার্যক্রম, লার্ভা ধ্বংস ও সচেতনতামূলক প্রচারণা চলছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন,

“এডিস মশা ধ্বংস করতে হলে শুধু সিটি করপোরেশন নয়, প্রত্যেক নাগরিকের অংশগ্রহণ জরুরি। নিজের বাড়ি পরিষ্কার রাখুন, প্রতিবেশীকেও সচেতন করুন।”

অন্যদিকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, এ বছর তারা ২০০-র বেশি মশক নিধনকর্মী নিয়োগ দিয়েছে এবং প্রতিটি ওয়ার্ডে আলাদা টিম কাজ করছে।

গ্রামাঞ্চলেও বাড়ছে সংক্রমণ

আগে ডেঙ্গু প্রধানত শহরকেন্দ্রিক ছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে
রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও ময়মনসিংহের ছোট শহর এবং উপজেলা পর্যায়েও ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শহর থেকে গ্রামের সংযোগ রাস্তায় ঘন যাতায়াত এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই বিস্তার ঘটছে।

সরকারের জরুরি নির্দেশনা

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালকে ২৪ ঘণ্টা ডেঙ্গু ইউনিট খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
এছাড়া জেলা পর্যায়ে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ, পর্যাপ্ত স্যালাইন ও ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বৈঠকে বলেছেন—

“ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। নিজের বাড়ি ও আশপাশ পরিষ্কার রাখলেই মশা জন্মাতে পারবে না।”

বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গু পরিস্থিতি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে এশিয়া ও লাতিন আমেরিকায় ডেঙ্গু সংক্রমণ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি
বিশ্বে এ বছর প্রায় ৫ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম বেশি।

মানুষের আতঙ্ক ও সচেতনতা বৃদ্ধি

ঢাকার বাসিন্দা ফারজানা ইসলাম বলেন,

“প্রায় প্রতিদিন কারও না কারও ডেঙ্গুর খবর শুনছি। এখন বাসার পানি জমতে দিই না, নিয়মিত স্প্রে করি।”

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডেঙ্গু সচেতনতামূলক পোস্ট, ভিডিও, ও কমিউনিটি ক্যাম্পেইনও বাড়ছে।
স্কুল-কলেজগুলোতেও শিক্ষার্থীদের সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ডেঙ্গু এখন বাংলাদেশের জন্য মৌসুমি নয়, বরং সারাবছরের জনস্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হচ্ছে।
প্রতিরোধ ও জনসচেতনতা ছাড়া এই রোগের বিস্তার ঠেকানো সম্ভব নয়।

সবশেষে মনে রাখতে হবে—
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হলো সচেতনতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা।

MAH – 13413 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button