
ডা. নাদিয়া ফারহীন
অক্টোবর মাসটি বিশ্বজুড়ে পরিচিত স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাস হিসেবে। প্রতি বছর এই সময়ে বিভিন্ন দেশ, সংস্থা ও স্বাস্থ্যসেবকগণ একযোগে কাজ করেন নারীদের মধ্যে স্তন ক্যানসার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে, এর প্রতিরোধের উপায় জানাতে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্তকরণের গুরুত্ব তুলে ধরতে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য— “প্রতিটি গল্প অনন্য, প্রতিটি যাত্রা মূল্যবান”— যা মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি রোগীর অভিজ্ঞতা আলাদা, কিন্তু সচেতনতা ও যত্ন সবার জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ।
স্তন ক্যানসার: ভীতি নয়, সচেতনতা হোক ঢাল
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই নারীদের সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হওয়া ক্যানসারগুলোর একটি হলো স্তন ক্যানসার। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর লাখো নারী এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, এবং অনেক ক্ষেত্রেই দেরিতে শনাক্ত হওয়ার কারণে চিকিৎসা জটিল হয়ে পড়ে।
তবে সুখবর হলো—সচেতনতা, নিয়মিত পরীক্ষা ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন মেনে চললে স্তন ক্যানসার প্রতিরোধ সম্ভব, এমনকি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে এটি সম্পূর্ণরূপে নিরাময়যোগ্য।
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনই সুরক্ষার প্রথম ধাপ
সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা
খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে ক্যানসারের সম্পর্ক গভীর। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ফলমূল, শাকসবজি, আঁশযুক্ত খাবার, মাছ ও কম চর্বিযুক্ত প্রোটিন রাখতে হবে।
যে খাবারগুলো এড়িয়ে চলা উচিত—
- প্রক্রিয়াজাত মাংস (যেমন সসেজ, সালামি)
- অতিরিক্ত চিনিযুক্ত পানীয়
- ভাজাপোড়া ও উচ্চ ফ্যাটযুক্ত খাবার
গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল যেমন বেরি, আপেল, কমলা, আঙ্গুর ইত্যাদি স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।
নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করুন
শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা ক্যানসারের অন্যতম ঝুঁকির কারণ। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটাহাঁটি, দৌড়, যোগব্যায়াম বা নাচের মতো শরীরচর্চা করুন।
গবেষণায় প্রমাণিত, নিয়মিত ব্যায়াম হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি ২৫–৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে।
যাঁরা ইতিমধ্যে চিকিৎসাধীন, তাঁরাও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হালকা ব্যায়াম করতে পারেন। এতে শারীরিক ক্লান্তি কমে, মানসিক প্রশান্তি আসে এবং শরীরে এন্ডোরফিন হরমোন নিঃসরণ হয়, যা সুখানুভূতি জাগায়।
প্রসাধনী ব্যবহারে সচেতনতা দরকার
বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যান্টিপার্সপিরেন্ট ও ডিওডোরেন্ট ব্যবহারের পর আন্ডারআর্ম এলাকায় ত্বকের রাসায়নিক পরিবর্তন স্তন কোষের ক্ষতি করতে পারে, বিশেষত শেভ করার পরপরই ব্যবহার করলে।
অনেক প্রসাধনীতে প্যারাবেন, ফথালেটস বা অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান থাকে, যা দীর্ঘদিন ব্যবহারে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে। যদিও গবেষণা এখনো চলছে, তবু ঝুঁকি এড়াতে প্রসাধনী ব্যবহারের আগে উপাদান দেখে নেওয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
মানসিক স্বাস্থ্য: অদৃশ্য প্রতিরক্ষা
স্তন ক্যানসার শুধু শরীর নয়, মনের ওপরও প্রভাব ফেলে। অনেকে ভয়ে বা সামাজিক কুসংস্কারের কারণে বিষয়টি গোপন রাখেন। এতে রোগ দ্রুত ছড়ায় ও মানসিক চাপ বাড়ে।
মানসিক শক্তি বাড়াতে যা করতে পারেন—
- পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান
- পছন্দের কাজ বা শখে সময় দিন
- নিয়মিত ধ্যান বা মেডিটেশন করুন
- কাউন্সেলিং বা সাপোর্ট গ্রুপে যুক্ত হোন
মন ভালো থাকলে শরীরও দ্রুত সুস্থ হয়। মানসিক শান্তি ক্যানসারের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
নিয়মিত পরীক্ষা ও স্ক্রিনিংয়ের গুরুত্ব
স্তন ক্যানসার প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো নিয়মিত পরীক্ষা ও সচেতন পর্যবেক্ষণ।
নিজে পরীক্ষা করুন
প্রতি মাসে একবার, মাসিক শেষ হওয়ার ৫–৭ দিন পর নিজের স্তন নিজেই পরীক্ষা করুন। লক্ষ্য করুন—
- কোনো অস্বাভাবিক গাঁট বা চাকা আছে কি না
- বোঁটার আকৃতি বা রং পরিবর্তন হয়েছে কি না
- কোনো তরল নিঃসরণ হচ্ছে কি না
২০ বছর বয়সের পর থেকে প্রতি তিন বছর অন্তর চিকিৎসকের কাছে পরীক্ষা করানো উচিত।
ম্যামোগ্রাম করান
৪০ বছর বয়সের পর থেকে অন্তত ১–২ বছর অন্তর ম্যামোগ্রাম করানো প্রয়োজন। যদি পরিবারে কারও স্তন বা ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের ইতিহাস থাকে, তাহলে আরও আগে থেকেই শুরু করা উচিত।
ঝুঁকি কার বেশি
স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায় এমন কিছু কারণ হলো—
- বয়স ৪০ বছরের বেশি হওয়া
- পরিবারের কারও স্তন বা ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের ইতিহাস থাকা
- হরমোনের ওষুধ দীর্ঘদিন ব্যবহার করা
- স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন
- ধূমপান ও মদ্যপান
- প্রথম সন্তান জন্ম দিতে দেরি করা
- দুধ উৎপন্ন হওয়ার পরও শিশুকে বুকের দুধ না খাওয়ানো
এই ঝুঁকিগুলো জানা থাকলে আগে থেকেই সাবধান থাকা যায়।
প্রতিরোধের সহজ উপায়
১. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
২. প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন
৩. তাজা ফল ও শাকসবজি খান
৪. ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন
৫. সন্তান জন্মের পর নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ান
৬. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন
পরিবার ও সমাজের ভূমিকা
স্তন ক্যানসার ধরা পড়লে রোগী মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারেন। তখন পরিবারের সহানুভূতি ও ভালোবাসা সবচেয়ে বড় ওষুধ।
পরিবারের উচিত রোগীর পাশে থাকা, তাকে উৎসাহ দেওয়া, প্রয়োজন হলে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা। সমাজকেও সচেতন হতে হবে যেন কেউ ক্যানসারে আক্রান্ত হলে লজ্জা নয়, সহায়তা পায়।
সঠিক চিকিৎসা, মানসিক সমর্থন ও ইতিবাচক মনোভাব একজন রোগীকে দ্রুত সুস্থ করে তুলতে পারে।
স্তন ক্যানসার এখন আর অজানা বা অপ্রতিরোধ্য নয়। সচেতনতা, সময়মতো পরীক্ষা ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমে আমরা নিজেরা এবং সমাজের অন্য নারীদের এই রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখতে পারি।
প্রতি নারীর উচিত নিজের শরীর সম্পর্কে সচেতন থাকা, নিয়মিত পরীক্ষা করা এবং পরিবর্তনগুলো নজরে রাখা।
মনে রাখবেন—
প্রতিরোধই শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা।
MAH – 13393 I Signalbd.com