
২০২৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, ইরানের এক হিজাববিরোধী বিক্ষোভকারীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত বিচারবিষয়ক প্রতিষ্ঠান “মিজান”-এর ওয়েবসাইটে এ তথ্য প্রকাশিত হয়। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের তীব্র নিন্দার মুখে পরিণত হয়েছে।
প্রেক্ষাপট: মহসা আমিনির মৃত্যু ও “মহিলা, জীবন, স্বাধীনতা” আন্দোলন
২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইরানের নৈতিকতা পুলিশ মহসা (জিনা) আমিনিকে হিজাব “ভুলভাবে পরার” অভিযোগে আটক করে। একদিনের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় ইরানের বিভিন্ন শহরে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়, যা “Woman, Life, Freedom” (মহিলা, জীবন, স্বাধীনতা) স্লোগানে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ নিহত হয়, হাজার হাজার গ্রেপ্তার হয়। জাতিসংঘের Fact-Finding মিশন এই পরিস্থিতিকে “মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ” হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
ইরানের বিচার ব্যবস্থায় ‘ছদ্মরায়’ মামলা ও দ্রুত রায় কার্যকর
রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল অনেক মামলায়, বিশেষ করে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে, ইরানি কর্তৃপক্ষ ‘মহরেবাহ’ বা “আল্লাহবিরোধী যুদ্ধ” হিসেবে মামলা চালিয়ে দ্রুত রায় কার্যকর করে। এসব মামলায় অভিযুক্তদের কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, একাকী কারাবন্দিত্ব, হুমকি-ধামকি ও স্বীকারোক্তি নেওয়ার মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
মোজাহেদ (আব্দুল্লা) কুরকুরির মামলা: নিষ্ঠুর বিচার ব্যবস্থার এক দৃষ্টান্ত
২০২৫ সালের ১১ জুন, মোজাহেদ (আব্দুল্লা) কুরকুরি নামে এক আন্দোলনকারীকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তাকে ২০২২ সালের বিক্ষোভের সময় ইজেহ প্রবাসে সংঘটিত গুলিতে জড়িত থাকার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, যেখানে শিশুসহ সাতজন নিহত হয়। এই রায় ইরানের বিচার ব্যবস্থার নিষ্ঠুরতা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রমাণ।
মেহরান বাহরামিয়ান: সাম্প্রতিকতম ফাঁসির রায়
২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে ইসফাহানের সেমিরোম এলাকায় পুলিশের গাড়িতে গুলি চালিয়ে মোহসিন রেজাই নামে এক কর্মকর্তার মৃত্যু ও অনেকে আহত হওয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত মেহরান বাহরামিয়ানকে ২০২৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ফাঁসির সাজা কার্যকর করা হয়।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবাধিকার সংস্থার অভিযোগ
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মোজাহেদ কুরকুরির মৃত্যুদণ্ড নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এটি ইরানি কর্তৃপক্ষের জীবন অধিকারবিরোধী মনোভাবের প্রকাশ এবং বিচ্ছিন্নতা লাঞ্ছনার হাতিয়ার হিসেবে মৃত্যুদণ্ড ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়। তারা এই ধরনের ‘ছদ্মরায়’ বিচার-প্রক্রিয়া ও চাপদানের ঘটনাকে আন্তর্জাতিকভাবে দায়মুক্তির আওতাধীন অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছে।
জাতিসংঘ ভিত্তিক প্রতিবেদনগুলোতেও ইরানের বিরুদ্ধে হিজাব আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ, ড্রোন ও ফেসিয়াল রিকগনিশন ব্যবহারে নজরদারি, এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিচার ব্যবস্থার অপব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।
ইরানের বর্তমান পরিস্থিতি: নজরদারি থেকে বিমূর্ত নিষ্ঠুরতা
২০২৪ সালে ‘নূর প্ল্যান’ নামে ব্যাপক হিজাব কঠোরতা আরোপ করা হয়। এই পরিকল্পনার আওতায় সড়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নজরদারি, ড্রোন ব্যবহার, আটক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বৃদ্ধি পায়। অনেক নারী ও মেয়েকে আটক, নির্যাতন ও প্রকাশ্যে হেয় করা হয়।
বিচার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা
ইরানের আদালত ও নিরাপত্তা বাহিনী আন্দোলনকারীদের হত্যা, নির্যাতন ও মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে শাসন-ভীতি সৃষ্টি করছে। মুখোশধারী বিচার প্রক্রিয়া, আমলাতান্ত্রিক চক্রান্ত, এবং আন্তর্জাতিক শাস্তির অভাব এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ইরানের সাম্প্রতিক এই ঘটনা—এক বিক্ষোভকারীকে বিচারবিহীনভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর—দেশটির বিচারব্যবস্থা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির গভীর সংকটের প্রতিফলন। স্বাধীন বিচার ও মানবাধিকারের অভাব, ‘ছদ্মরায়’ মামলা, এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সঙ্গে গঠিত এই দৃষ্টান্ত ইরানের জনগণের মধ্যে ভয়, নিরাপত্তা ও প্রতিরোধের সংস্কৃতিকে রূপান্তরিত করছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে মানবাধিকার সংস্থা, জাতিসংঘ ও গণতান্ত্রিক দেশগুলোর প্রতি আহ্বান, আজই কঠোর প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের।
MAH – 12663, Signalbd.comহিজাব বিরোধী আন্দোলনের এক বিক্ষোভকারীকে ফাঁসিতে ঝোলাল ইরান