২০২৪ সালে ১২১ কোটি টাকার বিশাল লোকসান আইএফআইসি ব্যাংকের

২০২৪ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আইএফআইসি ব্যাংক রেকর্ড ১২১ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষায় উঠে এসেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা এবং সাবেক চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের শাসনামলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকার অনিয়মিত অর্থ উত্তোলনই এই লোকসানের মূল কারণ।
এনালাইসিস বলছে, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ব্যাংকটির ওপর অপ্রতিরোধ্য প্রভাব রেখে যাওয়া এই ক্ষমতাধর রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী গ্রুপ বেক্সিমকো ব্যাংকটির সম্পদ ও মূলধন ব্যবস্থাপনায় সরাসরি প্রভাব ফেলেছে, যার প্রভাব পড়েছে সাধারণ শেয়ারহোল্ডার ও আমানতকারীদের ওপর।
২০২৪ সালে আইএফআইসি ব্যাংকের আর্থিক চিত্র
আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সর্বশেষ বৈঠকে ২০২৪ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা ও অনুমোদনের পর জানা গেছে:
- নিট লোকসান: ১২১ কোটি টাকা
- শেয়ারপ্রতি লোকসান (EPS): ৬৩ পয়সা
- ২০২৩ সালে EPS ছিল: ১ টাকা ৫৬ পয়সা (লাভ)
- শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (NAVPS): ১৮ টাকা ১৬ পয়সা
- শেয়ারপ্রতি ক্যাশ ফ্লো: ৩ টাকা ৪৮ পয়সা (২০২৩ সালে ছিল ৩ টাকা ৩৬ পয়সা)
উল্লেখযোগ্যভাবে, লোকসানের ফলে ব্যাংকটি ২০২৪ সালের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি, যা সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য হতাশাজনক খবর।
বার্ষিক সাধারণ সভা (AGM) ও রেকর্ড ডেট
ব্যাংকটির বার্ষিক সাধারণ সভা (AGM) অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার, সকাল ১১টায়। এটি হবে হাইব্রিড পদ্ধতিতে।
রেকর্ড তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭ জুলাই, ২০২৫।
খারাপ ঋণের বোঝা: বিপদের মূল উৎস
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটির মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৭ হাজার ১৮২ কোটি টাকা এখন খেলাপি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা মোট ঋণের ৩৮.৪৯ শতাংশ।
ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রকদের মতে, কোনো প্রতিষ্ঠানে ১০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। সেখানে আইএফআইসি ব্যাংকের খেলাপির হার প্রায় ৪০ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে, যা মারাত্মক অস্থিরতা এবং দায়বদ্ধতার সংকেত বহন করে।
সালমান এফ রহমানের সময়কার অনিয়ম ও প্রভাব
২০১৫ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন সালমান এফ রহমান। এই সময়েই ব্যাংকটি থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ নতুন নতুন কোম্পানির নামে, আবার কখনো নামে-বেনামে বেরিয়ে গেছে।
তথ্য বলছে:
- ২০২০ সালে তিনি উত্তোলন করেন: ৪৪০ কোটি টাকা
- ২০২১ সালে কোনো উত্তোলন না থাকলেও
- ২০২২ ও ২০২৩ সালে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা নতুন প্রতিষ্ঠানের নামে উত্তোলন করা হয়
- সব মিলিয়ে সুবিধাভোগের পরিমাণ: প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বাধা
প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন:
“২০২২ সালে আইএফআইসি ব্যাংক কয়েকটি নতুন প্রতিষ্ঠানের নামে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ অনুমোদন করে। এই অর্থ দ্রুত নগদে তুলে নেওয়া হয়। পরিদর্শনের জন্য একটি দল পাঠানো হলে সালমান এফ রহমান সরাসরি গভর্নরকে ফোন করে চাপ প্রয়োগ করেন। ফলস্বরূপ পরিদর্শন বন্ধ হয়।”
তিনি আরও জানান, মূলত বেক্সিমকো গ্রুপ এই সুবিধার অন্যতম বড় গ্রহীতা। এরপর থেকেই ব্যাংকটির প্রতি নজরদারি কার্যত বন্ধ হয়ে যায়, যা ২০২৪ সালের লোকসানে বড় ভূমিকা রেখেছে।
আগের বছরের মুনাফা বনাম বর্তমানের বিপর্যয়
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়:
- ২০২২ সালের নিট মুনাফা: ৩৪৪ কোটি টাকা
- ২০২৩ সালের নিট মুনাফা: ৩০০ কোটি টাকা
- অথচ ২০২৪ সালে: বিশাল ১২১ কোটি টাকার লোকসান!
এই ধসের জন্য অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মূলত অভ্যন্তরীণ করপোরেট গবর্ন্যান্সের ব্যর্থতা, রাজনৈতিক প্রভাব, এবং দায়বদ্ধতার অভাবকে দায়ী করছেন।
বাজার বিশ্লেষকদের মতামত
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ব্যাংকটির লোকসান আগামীতেও কমার সম্ভাবনা কম, যদি না দায়ীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয় এবং ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ পুনঃকর্মসূচির আওতায় দ্রুত পুনরুদ্ধার করা যায়।
এছাড়া, ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা এই মুহূর্তে প্রবল ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, বিশেষ করে যারা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারী।
সমাধানের পথ কী?
ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞদের মতে, আইএফআইসি ব্যাংককে স্থিতিশীল করতে হলে যেসব পদক্ষেপ জরুরি:
- সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও স্বাধীন নিরীক্ষা
- দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা
- রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিচালনা পর্ষদ গঠন
- বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃতদারকি কার্যক্রম জোরদার
- খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে কঠোর উদ্যোগ
- সম্পদের গুণগত মান উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ
২০২৪ সালে আইএফআইসি ব্যাংকের ১২১ কোটি টাকার নিট লোকসান শুধু একটি আর্থিক ব্যর্থতা নয়; এটি দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর রাজনৈতিক ও করপোরেট প্রভাবের এক করুণ চিত্র। দায়িত্বশীলতা, স্বচ্ছতা ও আইনের শাসন ছাড়া এমন প্রভাব আরও অনেক ব্যাংকের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।