মূল্যস্ফীতির চাপে, ২০২৫ সালে অতিদরিদ্র হতে পারে ৩০ লাখ লোক

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেই বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ
২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার প্রাক্কালে দেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল্যস্ফীতি। চাল, ডাল, তেল, আটা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দামই এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করায় ভোগান্তি বেড়েছে সীমিত ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের মধ্যে। দৈনন্দিন খরচ মেটাতে অনেক পরিবারকে ধারকর্জ করতে হচ্ছে, খাবারের পরিমাণ কমাতে হচ্ছে, এমনকি অনেকেই মানসিক চাপেও ভুগছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি টিকে থাকলে তা দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্বব্যাংক আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, শুধু ২০২৫ সালেই দেশে অতিরিক্ত ৩০ লাখ মানুষ অতিদরিদ্র শ্রেণিতে পড়ে যেতে পারে। এদের বেশিরভাগই বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার উপরে অবস্থান করলেও মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় নিচে নেমে যাবে।
মূল্যস্ফীতি: গত এক বছরের চিত্র
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)–এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ১০ মাস দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি ছিল। চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতি ১০.২১ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক ছিল খাদ্য মূল্যস্ফীতি, যা জুলাই মাসে ১৪.১০ শতাংশে পৌঁছায়—গত ১৩ বছরে সর্বোচ্চ।
কোন কোন পণ্যের দাম বেড়েছে?
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে খাদ্যপণ্যে। টিসিবি’র তথ্যমতে:
- মোটা চালের দাম বেড়েছে ৫% (বর্তমানে কেজিপ্রতি ৫০ টাকা)
- অন্যান্য চালের দাম বেড়েছে ১০-১১%
- ভোজ্যতেল: ১২-২২% বৃদ্ধি
- ডিমের দাম ডজনপ্রতি পৌঁছেছিল ১৬০-১৭০ টাকায়
- পেঁয়াজ, রসুন, আলু, মাছ ও মাংসেও ৫-১০% পর্যন্ত দাম বৃদ্ধি
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মূল্যস্ফীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে চাল—২০% অবদান নিয়ে এককভাবে সর্বোচ্চ।
প্রকৃত আয় কমেছে, আয়–ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতা
মূল্যস্ফীতি বাড়লেও দেশের মজুরি বা আয় সে হারে বাড়েনি। বিবিএস–এর তথ্যমতে, গত এক বছরে কোনো মাসেই জাতীয় গড় মজুরি বৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ অতিক্রম করেনি। পক্ষান্তরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের ওপরে। এর ফলে প্রকৃত আয় কমে গেছে, আর সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।
বিশেষ করে দেশের ৬ কোটির বেশি কর্মজীবী মানুষ যারা অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন (যেমন নির্মাণ শ্রমিক, পরিবহন কর্মী, হোটেল–রেস্তোরাঁয় কর্মরত শ্রমিক), তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত ও পরামর্শ
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান জানান, “মানুষ কষ্টে আছে, আর এই কষ্ট সাময়িক নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলবে। মানুষ খাবার কম খাচ্ছে, পণ্য কিনছে কম। দীর্ঘদিন বিনিয়োগ না হওয়া, কর্মসংস্থান না বাড়া এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে।”
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা আরও কঠোর করতে হবে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে কৌশল নির্ধারণ, বাজারে নজরদারি বৃদ্ধি, মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ এবং চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
সরকার কী করছে?
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন:
- সুদের হার বাড়ানো
- তেল, ডিম, আলু, পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যে শুল্ক-কর কমানো
- ডলার সংকট কাটিয়ে আমদানি স্বাভাবিক রাখা
তবে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাজারে চাঁদাবাজি এখনো বন্ধ হয়নি। ফলে এসব পদক্ষেপের বাস্তব সুফল পুরোপুরি পাচ্ছেন না ভোক্তারা।
দারিদ্র্যের ভয়াবহতা: বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস
২০২৫ সালে অতিদরিদ্র জনসংখ্যার হার ৯.৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ২০২৪ সালে এই হার ছিল ৭.৭ শতাংশ। এ বছর অতিরিক্ত ৩০ লাখ মানুষ এই শ্রেণিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, অতিদারিদ্র্য বৃদ্ধির প্রধান তিনটি কারণ:
- প্রকৃত আয় কমে যাওয়া
- শ্রমবাজার দুর্বল হওয়া
- অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মন্থর গতি
বিবিএস অনুযায়ী, বর্তমানে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ, যার মধ্যে গ্রামে ২০.৩% এবং শহরে ১৭.৭%।
যদি একজন ব্যক্তি প্রতি মাসে গড়ে ৩,৮২২ টাকার নিচে আয় করেন, তবে তিনি দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছেন বলে ধরা হয়।
বাজেটে চাই কার্যকর ও মানবিক উদ্যোগ
চলতি বাজেটেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও দরিদ্র মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। শুধু সংখ্যা বা পরিসংখ্যান নয়, বাস্তব পরিস্থিতি বুঝে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিশেষ করে নগদ সহায়তা, খাদ্য নিরাপত্তা, নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর প্রসার এবং বাজারে স্বচ্ছতা আনার দিকগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে।
- টানা ১০ মাস ধরে ১০ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি
- খাদ্য মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ ১৪.১০ শতাংশ
- প্রকৃত মজুরি বাড়েনি, আয় কমেছে
- ২০২৫ সালে অতিদরিদ্র হতে পারে অতিরিক্ত ৩০ লাখ মানুষ
- সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে অনানুষ্ঠানিক খাতের ৬ কোটির বেশি কর্মজীবী