অর্থনীতি

৪০৫ কোটি টাকার লোকসানে ডুবেছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক

Advertisement

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ২০২৪ অর্থবছরে চরম আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। এক সময় মুনাফার ধারাবাহিকতায় থাকা ব্যাংকটি গত বছর সমন্বিতভাবে ৪০৫ কোটি টাকা লোকসান করেছে। আর্থিক অনিয়ম, স্বার্থান্বেষী ঋণ বিতরণ এবং আগের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগই এই বিশাল ক্ষতির মূল কারণ বলে মনে করছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

২০২৩ সালে যেখানে ব্যাংকটি ৩২৯ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল, সেখানে এক বছরে চিত্র পাল্টে গিয়ে বিপর্যয়ের রূপ নিয়েছে। গতকাল (২৯ মে) ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ সংক্রান্ত বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করা হয়। পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দেওয়া হচ্ছে না

এস আলম গ্রুপের প্রভাব ও দুর্নীতির ছাপ

ব্যাংকটির এই আর্থিক বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে এসেছে এস আলম গ্রুপ ও এর কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ। তিনি ছিলেন ব্যাংকটির আগের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তদন্তে জানা যায়, ব্যাংকের মোট ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশ-এরও বেশি এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে বিতরণ করা হয়। এ ঋণগুলোর অনেকটাই ছিল অনিয়মতান্ত্রিক, দলীয় সুবিধাপ্রাপ্ত এবং অর্থ ফেরতের নিশ্চয়তা ছাড়াই বিতরণকৃত।

পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন ও খেলাপি ঋণের উন্মোচন

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সম্পূর্ণরূপে পুনর্গঠন করে। এস আলম পরিবারের প্রভাব দূর করে সেখানে স্বতন্ত্র পরিচালক ও পেশাদার ব্যাংকারদের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

নতুন পর্ষদ দায়িত্ব গ্রহণের পরই ধরা পড়ে আগের সময়ে খেলাপি ঋণ কৃত্রিমভাবে নিয়মিত দেখানোর প্রচেষ্টা। এগুলোর প্রকৃত অবস্থা মূল্যায়ন করলে দেখা যায়, ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের হার ৩০ শতাংশে পৌঁছেছে, যা বর্তমানে আরও দ্বিগুণের কাছাকাছি বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অমানত-ঋণের ব্যবধান ও মূলধনের ঘাটতি

২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা, আর ঋণ বিতরণ হয়েছে ৬০ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ, আমানতের তুলনায় ১৭ হাজার ৭৯০ কোটি টাকার অতিরিক্ত ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এ ধরনের ব্যবধান ব্যাংকের তারল্য সংকটকে তীব্র করেছে।

এ ছাড়া ব্যাংকটির মূলধনের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা, যা দেশের কোনো বেসরকারি ব্যাংকের জন্যই অস্বাভাবিকভাবে উচ্চ মাত্রার সংকেত বহন করে।

ভুয়া মুনাফা দেখানোর অভিযোগ ও তাৎপর্য

ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের বরাতে জানা যায়, ২০২৩ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটি বহু ঋণের বিপরীতে প্রকৃত অর্থ আদায় না করেও কাগজে-কলমে মুনাফা দেখিয়েছে। ফলে ব্যাংকটি কর দিয়েছে এবং ভুয়া মুনাফার ভিত্তিতে শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ডও দিয়েছে। এ ধরনের আর্থিক কারসাজি ব্যাংকটির প্রকৃত আর্থিক ভিত্তিকে দুর্বল করেছে।

বর্তমানে ব্যাংকটি একদিকে খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যর্থ, অন্যদিকে উচ্চ সুদে ধার করা অর্থের বিপরীতে বেশি সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে আয় কমে গিয়ে ব্যয় বাড়ার ফলে ব্যাংকটির প্রকৃত ক্ষতি আরও বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার কঠোরতা

বাংলাদেশ ব্যাংক এ অবস্থায় ব্যাংকটিকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে ব্যাংকটি লোকসান দেখিয়ে হলেও সংরক্ষিত তহবিল গঠন করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড় দিত, তাহলে লোকসান আরও বাড়ত।

পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা: নতুন হিসাব, নতুন আমানত, মামলা

বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ব্যাংকটি সাধারণ মানুষের আস্থা ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে। সেপ্টেম্বর ২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত সময়ে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ নতুন হিসাব খোলা হয়েছে এবং এতে ৩ হাজার ৬২৪ কোটি টাকার নতুন আমানত এসেছে।

এ সময়কালে ২ হাজার ২২৩ কোটি টাকা ঋণ আদায় করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে ২৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ আদায়ের জন্য আদালতে মামলা চলছে বলে ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বক্তব্য

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্বে) আবু রেজা মো. ইয়াহীয়া বলেন,

“ঋণের বড় অংশ আদায় করা যাচ্ছে না। এ কারণে ব্যাংক পরিচালনায় সমস্যা হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি নতুন আমানত এনে ব্যাংকটির স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে।”

তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের আস্থাহীনতা কাটাতে স্বচ্ছতা ও নিয়মনীতি মেনে পরিচালনা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান আর্থিক সংকট কোনো একদিনের ফল নয়। এটি বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি ও নীতিহীন ঋণনীতির পরিণতি। পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘনিষ্ঠ তদারকি এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত পেশাদার ব্যবস্থাপনা।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button