২০২৫-২৬ বাজেট: আমদানি শুল্কে বড় পরিবর্তন

আগামী ২ জুন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এবারের বাজেটের সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে শুল্ক-করের পুনর্বিন্যাস ও সংস্কার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) ইতোমধ্যে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে বাজেটের প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে।
এই প্রস্তাবনায় আমদানি পর্যায়ে নতুন শুল্ক স্তর, সম্পূরক শুল্কের পরিমার্জন, দেশীয় শিল্প সুরক্ষা ও কিছু পণ্যে মূল্যস্ফীতি রোধে শুল্ক ছাড়—সবই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
শুল্ক কাঠামোয় নতুন স্তর যুক্ত হচ্ছে
বর্তমানে দেশে আমদানি শুল্কের ছয়টি স্তর রয়েছে: ০%, ১%, ৫%, ১০%, ১৫% এবং ২৫%। আগামী বাজেটে এই তালিকায় নতুন করে ৩% শুল্ক হার যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে প্রধান খাদ্যপণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, সার, বীজ এবং শিল্পের কাঁচামালে বিদ্যমান শুল্কহারে কোনো পরিবর্তন আসছে না।
সম্পূরক শুল্কের ক্ষেত্রেও বড় পরিবর্তন আসছে। বর্তমানে ১২টি স্তরে সম্পূরক শুল্ক বসে (১০% থেকে ৫০০%)। এবার সেখানে ৪০% নামের নতুন একটি স্তর যুক্ত হচ্ছে।
বাস ও মাইক্রোবাস আমদানিতে বড় ছাড়
রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোতে যানজট কমাতে ১৬-৪০ আসনের বাস আমদানির শুল্ক ১০% থেকে কমিয়ে ৫% করা হচ্ছে। একইভাবে মাইক্রোবাসের (১০-১৫ আসন) সম্পূরক শুল্ক ২০% থেকে কমিয়ে ১০% করার প্রস্তাব এসেছে।
হেলিকপ্টার আমদানিতে শুল্ক বসছে
বর্তমানে হেলিকপ্টার আমদানিতে কোনো শুল্ক নেই। আগামী বাজেটে এটি পরিবর্তন হয়ে ১০% আমদানি শুল্ক আরোপ হতে পারে। এর ফলে হেলিকপ্টারের আমদানি ব্যয় বাড়বে।
চিনির শুল্ক কমে বাজার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা
প্রতি টন পরিশোধিত চিনিতে বর্তমানে ৪,৫০০ টাকা আমদানি শুল্ক রয়েছে। এবার তা ৪,০০০ টাকা করা হতে পারে। এনবিআর মনে করছে, এতে বাজারে চিনির মূল্য স্থিতিশীল রাখা যাবে এবং রাজস্ব আয়ও বাড়বে।
দেশি সফটওয়্যার রপ্তানি উৎসাহে ছাড়
দেশি সফটওয়্যার রপ্তানিকে উৎসাহ দিতে বিদেশি অপারেটিং সিস্টেম, ডেটাবেজ, ডেভেলপমেন্ট টুলস এবং সিকিউরিটি সফটওয়্যারে শুল্ক ১০% থেকে কমিয়ে ৫% করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এতে দেশের ফ্রিল্যান্সার ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো উপকৃত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সংবাদপত্রের নিউজপ্রিন্টে শুল্কছাড়
গণমাধ্যম খাতকে সহায়তা করতে নিউজপ্রিন্টে কাস্টমস শুল্ক ৫% থেকে কমিয়ে ৩% করার প্রস্তাব এনেছে এনবিআর।
বিদেশি খেলনার দাম বাড়ছে
দেশীয় খেলনাশিল্পকে সুরক্ষায় খেলনা আমদানির ক্ষেত্রে টারিফ মূল্য প্রতি কেজি সাড়ে ৩ ডলার থেকে বাড়িয়ে ৪ ডলার করার প্রস্তাব আসছে। এর ফলে বিদেশি খেলনার দাম বাড়বে।
ক্রিকেট ব্যাট হবে আরও সুলভ
দেশে তৈরি ব্যাটে প্রয়োজনীয় উইলো কাঠ আমদানির শুল্ক ৩৭% থেকে কমিয়ে ২৬% করার প্রস্তাব রয়েছে। এতে দেশীয় ব্যাট উৎপাদক ও রপ্তানিকারকরা উপকৃত হবেন।
লিপস্টিক, ফেসওয়াশসহ রূপচর্চা সামগ্রীর দাম বাড়বে
বর্তমানে লিপস্টিকের ন্যূনতম শুল্কায়ন মূল্য প্রতি কেজি ২০ ডলার। এবার তা ৪০ ডলার করার প্রস্তাব এসেছে। এছাড়া ফেসওয়াশ, লিপলাইনার, আইলাইনার ইত্যাদিরও শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে।
বিদেশি চকলেটেও বাড়তি শুল্ক
চকলেট আমদানির ন্যূনতম মূল্য বর্তমানে ৪ ডলার। বাজেটে তা ১০ ডলার করার প্রস্তাব আসছে, ফলে দাম বাড়বে।
সিফুড, বিদেশি মাখন ও ড্রিংকের দাম কমছে
বিশেষ কিছু বিলাসপণ্য যেমন জাপানি সিফুড স্ক্যালোপে ২৫% থেকে ৫% শুল্কে নামিয়ে আনার প্রস্তাব রয়েছে। এছাড়া বিদেশি মাখন ও ড্রিংকের দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
শিল্প-কারখানার যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক ছাড়
রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে ব্যবহৃত ইন্ডাস্ট্রিয়াল র্যাকিং সিস্টেম ও মেটাল ডিটেক্টর মেশিনে যথাক্রমে ৫৮% ও ৩৭% শুল্ক রয়েছে। এই উচ্চ শুল্ক শিল্প উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধক বলে শুল্ক ছাড়ের সুপারিশ করা হচ্ছে।
১৭২টি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক কমানোর প্রস্তাব
এনবিআর সূত্র জানায়, সব মিলিয়ে ১৭২টি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক কমানোর প্রস্তাব এসেছে এবারের বাজেটে। এতে অনেক পণ্যের বাজার মূল্য কমে যেতে পারে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের প্রস্তাবিত শুল্ক পরিবর্তনগুলো দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা, মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং রপ্তানি উৎসাহ—এই তিনটি প্রধান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই প্রণয়ন করা হচ্ছে। একদিকে যেমন জনসাধারণের জন্য কিছু পণ্যে স্বস্তি আসবে, অন্যদিকে বিলাসপণ্য ও বিদেশি পণ্যে বাড়তি খরচ গুনতে হতে পারে।
সরকারের এই শুল্কনীতি কতটা কার্যকর হয়, তা নির্ভর করবে বাস্তবায়নের দক্ষতা ও বাজারের প্রতিক্রিয়ার ওপর। বাজেট ঘোষণার পর এসব প্রস্তাব চূড়ান্ত রূপ পেলে পণ্যের বাজার ও আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বড় পরিবর্তন আসতে পারে।