এলএনজির ভ্যাট প্রত্যাহারে বাজেটে বড় পরিবর্তন: কমতে পারে গ্যাসের দাম

আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি পর্যায়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজির ওপর আরোপিত ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট প্রত্যাহার করতে যাচ্ছে সরকার। সংশ্লিষ্ট সূত্র ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতে কিছুটা স্বস্তি ফিরবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ
বর্তমানে এলএনজি আমদানির সময় ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ২ শতাংশ অগ্রিম কর পরিশোধ করতে হয় পেট্রোবাংলাকে। এ ছাড়া গ্রাহকদের কাছে গ্যাস বিক্রির সময়ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ২ শতাংশ উৎসে কর দিতে হয়। পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, এতে দ্বৈত করের বোঝা তৈরি হচ্ছে, যা তাদের ব্যবসায়িক ভারসাম্যহীনতা বাড়াচ্ছে।
পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে বেশ কিছুদিন ধরেই আমদানি পর্যায়ের ভ্যাট ও কর প্রত্যাহারের জন্য সুপারিশ করা হচ্ছিল। অবশেষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সেই সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে আসছে বাজেটে এই পরিবর্তনের প্রস্তাব।
বাজেট ঘোষণা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
২০২৫ সালের ২ জুন দেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবার সংসদে না গিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণের মাধ্যমে বাজেট পেশ করবেন। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে এই বাজেট সাময়িক সময়ের জন্য হলেও অর্থনীতি ও জনজীবনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
এই বাজেটে এলএনজি আমদানিতে ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা আসার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত। এর মাধ্যমে সরকার ভোক্তাপর্যায়ে কিছুটা মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে চায়।
এলএনজি ব্যবহারের খাত ও গুরুত্ব
বাংলাদেশে এলএনজি মূলত ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং শিল্প খাতে। টেক্সটাইল, সিরামিকস, সিমেন্টসহ ভারী শিল্পগুলো এলএনজির ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া সীমিত পরিসরে গৃহস্থালি এবং যানবাহন খাতেও এলএনজি ব্যবহৃত হচ্ছে।
দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় আমদানি নির্ভরতা ক্রমশ বাড়ছে। বর্তমানে কাতার, ওমানসহ কয়েকটি দেশ থেকে বাংলাদেশ এলএনজি আমদানি করে। সরবরাহ ব্যাহত হলে এসব খাতে উৎপাদনেও প্রভাব পড়ে।
গ্যাসের দাম কমার সম্ভাবনা
এনবিআর-এর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আমদানি পর্যায়ে এলএনজির ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার করা হলে পেট্রোবাংলার উৎপাদন খরচ কমবে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিতরণমূল্যও কমার সুযোগ তৈরি হবে। যদিও গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), তবে খরচ কমলে বিইআরসি-ও নতুন দাম নির্ধারণে আগ্রহী হতে পারে।
বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও শিল্প খাতের বড় বড় গ্যাস-নির্ভর কোম্পানিগুলোর গ্যাস বিলের ওপর প্রভাব পড়বে। এটি উৎপাদন খরচ কমাতে সাহায্য করবে এবং পরোক্ষভাবে ভোক্তা পর্যায়ের পণ্যের দামেও প্রভাব ফেলতে পারে।
বেসরকারি খাতের আমদানি ও বিদ্যমান কর কাঠামো
বর্তমানে শুধু সরকার নয়, বেসরকারি পর্যায়েও এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। বেসরকারি আমদানিকারকরা এলএনজি ক্রয় করে তা পুনঃবিক্রি করছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে। তারা একইভাবে আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ২ শতাংশ অগ্রিম কর দিচ্ছে।
পেট্রোবাংলার হিসেবে, শুধু এলএনজির আমদানিতে সরকার বছরে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার মতো ভ্যাট আদায় করছে। ভ্যাট প্রত্যাহার মানে সরকারের রাজস্ব কিছুটা কমলেও দীর্ঘমেয়াদে গ্যাসের কম দামে উৎপাদন খরচ কমে যাবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
বিশেষজ্ঞ মতামত ও আশঙ্কা
গ্যাস খাত বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, “ভ্যাট প্রত্যাহার একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। বর্তমান বৈশ্বিক সংকটে গ্যাসের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সরকার যেন এই সিদ্ধান্তের অপব্যবহার না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।”
অপরদিকে, অর্থনীতিবিদ ড. জামিলুর হক বলেন, “ভ্যাট প্রত্যাহার করে দাম কমালেও সরকার যদি পরে ভর্তুকি কমিয়ে দেয়, তাহলে আবার দাম বাড়তে পারে। তাই বিষয়টি স্বচ্ছভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও নজরদারি
সরকারিভাবে জানানো হয়েছে, ভ্যাট প্রত্যাহার পরিকল্পনার পাশাপাশি পুরো এলএনজি আমদানি ও বণ্টন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি বিইআরসি এবং জ্বালানি বিভাগ এ বিষয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করছে যাতে ভ্যাট প্রত্যাহারের সুফল সরাসরি গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছে।
একই সঙ্গে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং অপ্রয়োজনীয় কর সুবিধা গ্রহণ বন্ধে জোরদার নজরদারি চালানো হবে বলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো আশ্বাস দিয়েছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এলএনজির ওপর ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক পরিবর্তন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এটি একদিকে যেমন শিল্প উৎপাদনে গতি আনবে, অন্যদিকে সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের বিল কিছুটা হলেও হ্রাস পেতে পারে।
এখন দেখার বিষয়, বাজেট ঘোষণার পর কীভাবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয় এবং তা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় কী ধরনের প্রভাব ফেলে।