পরিবেশবান্ধব পাতার বাসনে থাকছে না ভ্যাট: বাজেটে সবুজ উদ্যোগের বার্তা

দেশে পরিবেশবান্ধব পণ্যের ব্যবহার ও উৎপাদন বাড়াতে সরকারের চলমান প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এবার বাজেটে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আসতে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটে পরিবেশবান্ধব পাতার তৈরি বাসন-কোসনে ভ্যাট সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে করে এসব প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি সামগ্রীর দাম কমবে এবং এ শিল্পে উৎপাদক ও উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হবেন বলে আশা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
সবুজ পণ্য ব্যবহারে সরকারী ছাড়
বর্তমানে শালপাতা, নারকেলপাতা, খোলসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি প্লেট, বাটি, টেবিলওয়্যারসহ একবার ব্যবহারযোগ্য তৈজসপত্র তৈরিতে ১৫ শতাংশ মূসক (ভ্যাট) পরিশোধ করতে হয়। নতুন বাজেটে এই ভ্যাট সম্পূর্ণ তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা আগামী ২ জুন বাজেট ঘোষণার সময় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের মাধ্যমে জাতির উদ্দেশে জানানো হতে পারে।
এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, “এ ধরনের উদ্যোগ শুধু পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক নয়, বরং স্থানীয় শিল্পের জন্য নতুন দরজা খুলে দেবে। প্রাকৃতিক উপাদাননির্ভর এই শিল্পে অনেক মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন।”
প্লাস্টিক পণ্যে উল্টোভাবে বাড়ছে ভ্যাট
একদিকে পরিবেশবান্ধব তৈজসপত্রে ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও, অন্যদিকে প্লাস্টিক সামগ্রীর ওপর ভ্যাট বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে প্লাস্টিকের থালা, বাটি, টেবিলওয়্যার ও কিচেনওয়্যারে ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট ধার্য রয়েছে। এবার তা বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হতে পারে।
এর মাধ্যমে সরকার একটি দ্বিমুখী বার্তা দিতে চাচ্ছে—পরিবেশবান্ধব পণ্যকে উৎসাহ এবং প্লাস্টিক পণ্যকে নিরুৎসাহিত করা। বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক দূষণ এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশও এই সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণে করনীতির মাধ্যমে জনসচেতনতা ও বাজারচাহিদায় পরিবর্তন আনা জরুরি।
পরিবেশ ও অর্থনীতির যুগপৎ চিন্তা
বিশ্লেষকদের মতে, এই উদ্যোগ একদিকে পরিবেশবান্ধব জীবনযাত্রাকে উৎসাহিত করবে, অন্যদিকে স্থানীয় উৎপাদকদের জন্য একটি লাভজনক ক্ষেত্র তৈরি করবে। এ ধরনের বাসনপত্র ব্যবহারে প্লাস্টিকের ওপর নির্ভরতা কমবে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়ক হবে।
পরিবেশবিদ অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম বলেন, “ভ্যাট প্রত্যাহার একটি চমৎকার পদক্ষেপ। এতে করে দেশের পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলো টিকে থাকতে পারবে। একই সঙ্গে নতুন উদ্যোক্তারাও আগ্রহী হবেন।”
তিনি আরও বলেন, “প্লাস্টিকের ওপর বাড়তি ভ্যাট মানুষের মধ্যে বিকল্প খুঁজে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি করবে। তবে একইসঙ্গে দরকার প্রচার এবং স্থানীয় পণ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা।”
গ্রামীণ অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব
প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি তৈজসপত্রের বেশিরভাগ উৎপাদন হয়ে থাকে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এসব শিল্পের সঙ্গে বিপুল সংখ্যক নারী উদ্যোক্তা ও কুটির শিল্পজীবী মানুষ জড়িত। ফলে ভ্যাট প্রত্যাহার তাঁদের আয় বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই উদ্যোগে গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার হবে এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন বাজারের দরজা খুলবে।
ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার উদ্যোক্তা সালমা আক্তার বলেন, “আমরা নারকেল পাতায় প্লেট তৈরি করি। কিন্তু শহরে বিক্রি করতে গিয়ে ক্রেতারা দাম নিয়ে আপত্তি করতেন, কারণ ভ্যাটসহ খরচ বেড়ে যেত। এখন ভ্যাট উঠিয়ে দিলে আমাদের পণ্যের দাম কমবে, বিক্রিও বাড়বে।”
জাতীয়ভাবে ভোক্তাদের জন্য সুসংবাদ
ভ্যাট প্রত্যাহার শুধু উৎপাদক নয়, ভোক্তার জন্যও বড় সুখবর। বর্তমানে পরিবেশবান্ধব একবার ব্যবহারযোগ্য পাতার প্লেটের দাম তুলনামূলক বেশি। এখন দাম কিছুটা কমলে মানুষ প্লাস্টিকের বদলে এই ধরনের প্রাকৃতিক পণ্য ব্যবহারে আগ্রহী হবেন।
ঢাকার বনানীর বাসিন্দা রুবিনা ইসলাম বলেন, “বাড়িতে পারিবারিক অনুষ্ঠান হলে আমরা পাতার প্লেট ব্যবহার করার চেষ্টা করি। কিন্তু সেগুলো শহরে কিনতে গেলে অনেক দাম পড়ে। এখন যদি দাম কমে, তাহলে আমরাও বারবার ব্যবহার করতে পারব।”
বাজার বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে কীভাবে প্রভাব পড়বে
পণ্য মূল্য বিশ্লেষকদের মতে, ভ্যাট প্রত্যাহার হলে বাজারে পাতার প্লেটের দাম ১০-১২ শতাংশ কমতে পারে। তবে এটি নির্ভর করবে কাঁচামাল, পরিবহন ও খুচরা বিক্রেতার ওপরও।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় ৮০-১০০ কোটি টাকার পরিবেশবান্ধব পাতার তৈজসপত্র উৎপাদিত হয়। এর অধিকাংশই ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর কনজ্যুমার মার্কেটে বিক্রি হয়।
ভবিষ্যতে এই খাত থেকে আরও বেশি রাজস্ব আয় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব বলে মনে করছে এনবিআর। এক কর্মকর্তার ভাষায়, “ভ্যাট ছাড় দিলে এই খাত বড় হবে, পরোক্ষভাবে আমাদের রাজস্বও বাড়বে।”
বিকল্প নয়, মূলধারার অংশ করতে হবে
পরিবেশ আন্দোলন কর্মীরা মনে করেন, এসব পণ্যকে শুধু ‘বিকল্প’ হিসেবে না দেখে মূলধারার অংশ করা উচিত। এর জন্য দরকার সরকারি প্রচার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি দপ্তরে এর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।
‘সবুজ বাংলাদেশ আন্দোলন’-এর সমন্বয়ক রফিকুল আলম বলেন, “প্রতিটি স্কুল, কলেজ, সরকারি অফিসে পাতার প্লেট ব্যবহার শুরু হলে এটি একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হবে। সরকার যদি উদাহরণ সৃষ্টি করে, জনগণ নিশ্চয়ই অনুসরণ করবে।”