অনলাইনে জুয়া রোধে এআই ব্যবহারের নির্দেশনা বাংলাদেশ ব্যাংকের

বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার বিস্তার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এক বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। তরুণ প্রজন্মসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংক এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে অনলাইন জুয়া ও সংশ্লিষ্ট আর্থিক লেনদেন রোধে আধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে।
জারি হলো কঠোর নির্দেশনা
গত ২৮ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস ডিপার্টমেন্ট (PSD) থেকে এই সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। নির্দেশনাটি মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, পেমেন্ট সিস্টেম অপারেটর (PSO) এবং পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারদের (PSP) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীদের উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অনলাইন জুয়ায় জড়িত কোনো মার্চেন্ট বা সাধারণ গ্রাহককে সন্দেহজনক মনে হলে তার কার্যক্রম সার্বক্ষণিক নজরদারির আওতায় আনতে হবে।
এআই প্রযুক্তির ব্যবহার বাধ্যতামূলক
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, শুধুমাত্র প্রচলিত নজরদারি নয়, বরং প্রযুক্তিনির্ভর ও আধুনিক উপায়ে সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত করতে হবে। এর জন্য এআই প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা লেনদেনের ধরণ বিশ্লেষণ করে অস্বাভাবিক বা ঝুঁকিপূর্ণ কার্যক্রম চিহ্নিত করতে পারে। ফলে অনলাইন জুয়ায় ব্যবহৃত অ্যাকাউন্ট বা মার্চেন্ট শনাক্ত করা তুলনামূলকভাবে সহজ হবে।
দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ
যদি কোনো গ্রাহক বা মার্চেন্টের বিরুদ্ধে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সরেজমিন তদন্ত চালিয়ে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ নিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও দ্রুত অবহিত করার কথা বলা হয়েছে।
জনগণের মাঝে সচেতনতা তৈরির তাগিদ
বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু প্রযুক্তিগত নজরদারিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না; বরং এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছে। এ কারণে অনলাইন জুয়ার ক্ষতিকর প্রভাব ও আইনগত পরিণতি সম্পর্কে প্রচারণা চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
সাইবার সুরক্ষা ও ঠিকানা যাচাইয়ের নির্দেশ
নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, কোনো মার্চেন্ট যেই ঠিকানায় ব্যবসার অনুমতি নিয়েছেন, তিনি আসলেই সেই ঠিকানায় কার্যক্রম চালাচ্ছেন কি না, তা যাচাই করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সম্প্রতি প্রণীত ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর বিধান অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। আইন অনুযায়ী, অনলাইনভিত্তিক সকল আর্থিক সেবা প্রদানকারীকে নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় তাদের তথ্য হালনাগাদ রাখতে হবে এবং গ্রাহকদের সঠিক ও যাচাইকৃত ঠিকানায় সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
এআই প্রযুক্তির গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা
বর্তমান সময়ে এআই প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী আর্থিক খাতের নিরাপত্তা জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতি, মানি লন্ডারিং এবং জুয়াজনিত লেনদেন শনাক্তে এআই ব্যবহার একটি বাস্তবসম্মত ও কার্যকর পন্থা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশনা দেশীয় আর্থিক খাতে প্রযুক্তি নির্ভরতা বৃদ্ধি করবে এবং একই সঙ্গে অনলাইন জুয়ার মতো ভয়াবহ অপরাধ দমনে সহায়ক হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, একদিকে যেখানে আর্থিক প্রযুক্তির প্রসার ঘটছে, অন্যদিকে সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জুয়ার মতো অপরাধও বাড়ছে। তাই প্রযুক্তিকে অপরাধ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা অত্যন্ত সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তুতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশনা পাওয়ার পর অধিকাংশ এমএফএস, পিএসও এবং পিএসপি ইতোমধ্যে তাদের নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবস্থার উন্নয়ন শুরু করেছে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে এআই-ভিত্তিক লেনদেন বিশ্লেষণ টুলস, গ্রাহক আচরণ মূল্যায়ন এবং ঝুঁকি নিরূপণ ব্যবস্থাপনা চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, যাতে তারা এআই প্রযুক্তির ব্যবহার বুঝে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে পারে।
ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, অনলাইনভিত্তিক আর্থিক অপরাধ প্রতিরোধে তারা আরও কয়েকটি ধাপে কাজ করার পরিকল্পনা করছে। এর মধ্যে রয়েছে একটি কেন্দ্রীয় নজরদারি ব্যবস্থা চালু করা, যেখানে সব আর্থিক লেনদেনের তথ্য এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে রিয়েল-টাইম পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।
এছাড়া গ্রাহকদের শনাক্তকরণ পদ্ধতিতে বায়োমেট্রিক ও মাল্টি-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়ানোরও পরিকল্পনা রয়েছে। এইসব প্রযুক্তি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে অনলাইন জুয়ার মতো অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
উপসংহার
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে দেশের আর্থিক খাতকে আরও স্বচ্ছ ও নিরাপদ করে তুলবে। অনলাইন জুয়াকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক ও আর্থিক অপরাধের বিস্তার ঘটছে, তা নিয়ন্ত্রণে এই প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে। তবে এর কার্যকারিতা নির্ভর করবে কতটা দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারে, তার ওপর।