আইটিসি-তে ১৪০ কোটি ডলারের শেয়ার বিক্রি করছে বিএটি

বহুজাতিক তামাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) তাদের অন্যতম প্রধান বিনিয়োগ—ভারতের বৃহৎ ভোগ্যপণ্য কোম্পানি আইটিসি লিমিটেড-এ থাকা ২.৩ শতাংশ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছে। এই ব্লক ট্রেড লেনদেনের মাধ্যমে প্রায় ১৪০ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা) সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি শুধুই একটি সাধারণ শেয়ার লেনদেন নয়—বরং বিএটির সাম্প্রতিক আর্থিক অবস্থান, বাজার কৌশল ও বৈশ্বিক ট্যাক্স পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই সিদ্ধান্ত আসছে।
ব্লক ট্রেডের মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের লেনদেন
২৮ মে মঙ্গলবার প্রকাশিত এক ঘোষণায় বিএটি জানায়, তারা আইটিসি-তে থাকা ২৯ কোটি শেয়ার পর্যন্ত বিক্রি করবে, যার প্রতি শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০০ রুপি। উল্লেখ্য, এই মূল্য সোমবার শেয়ারবাজারে আইটিসি শেয়ারের সমাপনী দামের চেয়ে প্রায় ৭.৮ শতাংশ কম।
এই ব্লক ডিলটি বাস্তবায়নে গোল্ডম্যান স্যাক্স এবং সিটিগ্রুপ নেতৃত্ব দিচ্ছে। ভারতের শেয়ারবাজারে এ সপ্তাহে এটিই দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় ব্লক ট্রেড। এর আগে ইনডিগো এয়ারলাইনসের সহপ্রতিষ্ঠাতা রাকেশ গাঙ্গওয়াল প্রায় ১.৩৬ বিলিয়ন ডলারের শেয়ার বিক্রি করেন।
শেয়ার বিক্রির পরেও বিএটির নিয়ন্ত্রণে আইটিসি
বিএটি স্পষ্ট করেছে, এই বিক্রির পরেও তারা আইটিসি-তে ২৩.১ শতাংশ মালিকানা ধরে রাখবে, ফলে প্রতিষ্ঠানটি আইটিসি-র সবচেয়ে বড় একক বিনিয়োগকারী হিসেবেই থাকবে। ফলে ব্যবসায়িক অংশীদারিত্বে বড় কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কেন এই বিক্রি? আর্থিক কৌশলের পেছনের কারণ
এই শেয়ার বিক্রির মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বিএটি জানিয়েছে, তারা এই অর্থ দিয়ে ২০২৫ সালের জন্য ঘোষিত ১.১ বিলিয়ন পাউন্ডের শেয়ার বাইব্যাক কর্মসূচিকে ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড বাড়াবে, যার মোট পরিমাণ দাঁড়াবে ১.৩ বিলিয়ন পাউন্ড (প্রায় ১.৭৬ বিলিয়ন ডলার)।
এর পাশাপাশি, প্রতিষ্ঠানটি আশ্বাস দিয়েছে যে, এই লেনদেন তাদের বার্ষিক আয়ের পূর্বাভাসে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।
পেছনের গল্প: কর সংকট এবং বাংলাদেশ সংক্রান্ত আশঙ্কা
উল্লেখযোগ্যভাবে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিএটি বার্ষিক রাজস্বে মাত্র ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের মতো দেশে কর সংক্রান্ত প্রতিকূলতা বা ‘ট্যাক্স হেডউইন্ডস’ তাদের প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে। একই ধরনের প্রতিকূলতা রয়েছে অস্ট্রেলিয়াতেও।
বাংলাদেশে কর কাঠামো পরিবর্তনের কারণে বিএটি বাংলাদেশ লিমিটেডের মুনাফায় বিঘ্ন ঘটে। যদিও প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে এখনো অন্যতম বড় বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং দেশীয় পুঁজিবাজারে অন্যতম বড় কোম্পানি, তবুও ট্যাক্স পলিসির পরিবর্তন তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে।
অতীতেও বড় শেয়ার বিক্রি করেছে বিএটি
এই প্রথম নয়—২০২৪ সালেও বিএটি আইটিসি-তে থাকা প্রায় ৪৩৭ মিলিয়ন শেয়ার (প্রায় ৩.৫ শতাংশ) বিক্রি করেছিল, যার বাজার মূল্য ছিল প্রায় ২০০ কোটি ডলার। এটি ভারতের শেয়ারবাজার ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম ব্লক ডিল ছিল।
বিএটির মালিকানাধীন বিখ্যাত ব্র্যান্ডের মধ্যে রয়েছে ডানহিল, লাকি স্ট্রাইক, এবং রথম্যানস। সাম্প্রতিক সময়ে, তামাক পণ্যের স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং সরকারের কঠোর নীতির কারণে কোম্পানিটির সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।
বিনিয়োগকারীদের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এই ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ একে বিএটির নগদ প্রবাহ ও শেয়ারপ্রতি মুনাফা বাড়ানোর কৌশল হিসেবে দেখছেন, কেউবা আবার আইটিসি-তে দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণ কমানোর ইঙ্গিত হিসেবেও দেখছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএটির পুঁজিগত ঘাটতি বা ব্যয় সামাল দিতে ভারতের বাজারে এই শেয়ার বিক্রিকে কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যায়। তবে এতে বাংলাদেশের বাজারে বা বিএটি বাংলাদেশ লিমিটেডের সরাসরি প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আপাতত কম।
সংক্ষেপে মূল তথ্য:
- বিএটি আইটিসি-তে ২.৩% শেয়ার বিক্রি করছে
- লেনদেনের সম্ভাব্য মূল্য ১৪০ কোটি ডলার
- ব্লক ট্রেডে ফ্লোর প্রাইস ৪০০ রুপি
- বিক্রির পরও বিএটি থাকবে আইটিসির শীর্ষ বিনিয়োগকারী
- শেয়ার বাইব্যাক কর্মসূচিতে ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড সংযোজন
- বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ায় ট্যাক্স সংকট বিএটির কৌশলগত রদবদলের অন্যতম কারণ
শেষ কথা:
এই বিক্রিকে শুধু শেয়ার লেনদেন হিসেবে নয়, বরং বৃহৎ আর্থিক কৌশলের অংশ হিসেবে দেখছেন বাজার বিশ্লেষকরা। বিএটি যেভাবে আর্থিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস করছে, তা ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানটির বৈশ্বিক কার্যক্রমে আরও পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে এর প্রভাব সরাসরি নাও পড়তে পারে, তবে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক দৃষ্টিতে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা জরুরি।