অর্থনীতি

বিদেশি বিনিয়োগ বিভ্রান্তি ৯ মাসেই ১ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব পেয়েছে বিডা

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ নেই—এমন মন্তব্যকে “তথ্যবিচ্যুত ও একপেশে” আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। সংস্থাটি বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রস্তাবিত বিদেশি বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছে। একই সময়ে নেট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দেশের বিনিয়োগ পরিবেশে বিদেশি আগ্রহের একটি বড় প্রমাণ।

মঙ্গলবার (২৭ মে) বিডার পক্ষ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটি এক শিল্প সংগঠনের নেতার বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, বিনিয়োগ একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া, যার সফলতা বিচার করা উচিত প্রকৃত পরিসংখ্যান ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে।

বিদেশি বিনিয়োগের প্রকৃত চিত্র

বিডার তথ্যমতে, ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে ৭৩৯টি শিল্প প্রকল্প নিবন্ধিত হয়েছে। এর মধ্যে ৬৬টি প্রকল্প শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন এবং ৬১টি যৌথ উদ্যোগ। এসব বিনিয়োগ প্রকল্প শুধু বিনিয়োগের পরিমাণই নয়, বরং বাংলাদেশের প্রতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থার প্রতিফলন।

তাছাড়া, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এ সময়ের মধ্যে ১৬টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জমি ইজারার চুক্তি সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে ৬টি প্রকল্প শতভাগ বিদেশি এবং ৩টি যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্প। বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা) আরও ৩১টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইজারা চুক্তি করেছে, যা স্পষ্টভাবে দেখায়, দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগের অনুপ্রবেশ ক্রমাগত বাড়ছে।

“জিটুজি প্রকল্পেই সীমাবদ্ধ বিডা”— অভিযোগের জবাব

সম্প্রতি এক শিল্প সংগঠনের প্রতিনিধি দাবি করেন, বিডা মূলত সরকার থেকে সরকার (G2G) প্রকল্পে সীমাবদ্ধ এবং গত আট মাসে কোনো নতুন বিদেশি বিনিয়োগ দেশে আসেনি। পাশাপাশি তিনি অভিযোগ করেন, বিডা দেশি ও বিদেশি উদ্যোক্তাদের মধ্যে কার্যকর সংযোগ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে যৌথ বিনিয়োগে বিদেশিদের আগ্রহ কমে গেছে।

বিডা তার বিবৃতিতে এ অভিযোগ অস্বীকার করে জানায়, “এই ধরনের ঢালাও মন্তব্য বাস্তবতাবর্জিত। বিডা ইতোমধ্যে দেশে ১ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাবিত বিনিয়োগ নিবন্ধন করেছে। সংস্থার মূল লক্ষ্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সংযোগ তৈরি করা, এবং এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।

বিনিয়োগে সময়সাপেক্ষ বাস্তবতা ও নেটওয়ার্কিং

বিডা বলছে, বিনিয়োগ পরিপক্ব হতে সময় লাগে, এবং এটিকে একপেশেভাবে বিচার করা সমীচীন নয়। সঠিক নীতিগত সহায়তা, অবকাঠামোগত সুবিধা ও বাজার বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বিনিয়োগ বাস্তবায়ন হয়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শুধুমাত্র প্রাথমিক আগ্রহ দেখান না, তারা বাজার যাচাই ও যৌথ অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেন।

এই প্রক্রিয়াকে গতিশীল করতে বিডা ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫’-এ নির্দিষ্ট খাতভিত্তিক B2B নেটওয়ার্কিং সেশনের আয়োজন করেছে। সেখানে দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের মধ্যে সরাসরি সংযোগ তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি, আগামী সপ্তাহে একটি উচ্চপর্যায়ের চীনা ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের টেক্সটাইল, ফুড প্রসেসিং ও ইলেকট্রনিকস খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে প্রায় ১০০টি B2B বৈঠকে অংশ নেবে।

বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে বিডার অঙ্গীকার

বিডার বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সংস্থাটি কেবল বিনিয়োগ নিবন্ধনেই নয়, বরং নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গঠনে কাজ করছে। এর আওতায় ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’, অনলাইন রেজিস্ট্রেশন, এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সহজীকৃত নির্দেশনা প্রবর্তন করা হয়েছে।

সংস্থাটি মনে করে, বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। তাই বিডা শিল্প নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে।

বিদেশি বিনিয়োগ: ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে যে আগ্রহ বজায় রয়েছে, তা প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ও প্রকল্পসংখ্যার দিক থেকেই প্রতিফলিত। বিশেষত, শ্রমঘন ও রপ্তানিমুখী শিল্পখাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সম্ভাবনা দেখছেন।

বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলার পরিবর্তন, চীন প্লাস ওয়ান কৌশল এবং দক্ষিণ এশিয়ার বাজার সম্প্রসারণের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে উঠে আসছে। এ অবস্থানে টিকে থাকতে হলে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রশাসনিক সহজীকরণে আরও জোর দিতে হবে।

উপসংহার

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ নেই—এমন বক্তব্য বাস্তবতাবর্জিত এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভুল বার্তা ছড়াতে পারে। বিডা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী, দেশটি ক্রমাগত বিদেশি বিনিয়োগে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে যৌথ উদ্যোগ, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে এই বিনিয়োগ প্রবাহ আরও দৃঢ় হবে বলে আশা করা যায়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button